আল্লাহ তাআলার জন্যই সকল
প্রশংসা, যিনি জীবন মৃত্যুর
একমাত্র মালিক। তাঁর
পবিত্রতা,
যিনি জরা-মৃত্যু-লয়-ক ্ষয়সহ সৃষ্টিজাত বিকাশ-বিনাশ
থেকে পবিত্র। আল্লাহর কৃতজ্ঞা,
সৃষ্টি হিসাবে মৃত্যুর অমোঘ
নিয়ম
অনুসরণ করেও হায়াতুন্নবীর
বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন নবীর উন্মত বানিয়ে যিনি আমাদের
ধন্য করেছেন।
আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়।
তিনি অনাদি অনন্ত, জন্মগ্রহণ ও
মৃত্যুবরণ
প্রক্রিয়া থেকে তিনি মুক্ত, পবিত্র। তিনি ছাড়া কোন
উপাস্য
নেই, তাঁর কোন শরিক নেই।
ওয়াফাত বরণ করেও হায়াত
প্রাপ্ত হায়াতুন্নবী হযরত
মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর
বান্দা, যাঁর বেলাদত বা মীলাদ
আছে, ওয়াফাত বা লোকান্তরিত
হওয়া আছে। তিনি রাসুল, যাঁর
সমকক্ষ কোন সৃষ্টি নেই।
আমরা বিশ্বাস করি রাসুলে করীম
রাউফ ও রহিম প্রিয়
নবী আল্লাহর সৃষ্টি মাখলুক।
তাঁকে আল্লাহর নিয়ম অনুসরণ
করতে হয়েছে। সৃষ্টির চিরা-
চরিত নিয়মকে মেনে নিয়ে তিনিও
মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন। এ
মাসেই তিনি ইহলীলা সাঙ্গ
করে সৃষ্টি নিয়ম বজায়
রেখে লোকান্তরে গমন করেন।
তবে তিনি সৃষ্টি হিসাবে যেমন অতুলনীয়, কারো মতো নন্,
তেমনি তাঁর বেলাদত, নবুওয়ত,
মুজিযা, ক্ষমতা,
মর্যাদা থেকে শুরু
করে ইহজীবনের শেষ পর্যন্ত
তথা ওয়াফাতও কারো মত নয়। যে আল্লাহ আগুনের
ভেতরে একপ্রকার কীটকেও
জ্যান্ত রাখেন, সেই তিনি তাঁর
হাবীবকে (দ.) বরযখের জীবনেও
জীবিত রাখতে সক্ষম।
এমনকি স্বাভাবিক হায়াতেই তিনি আছেন, যদিও তাঁর
ইন্তেকাল হয়েছে, এ কথাও সত্য।
স্বল্প সময়ের জন্য মৃত্যুর স্বাদ
গ্রহণ করলেও
তিনি হায়াতুন্নবী। কারণ তাঁর
ওয়াফাত আর কারো মত নয়। কোন পবিত্র আত্মাই আল্লাহর
কাছে পৌঁছতে অনীহা প্রকাশ
করে না। স্বয়ং নবীজির ফরমান
মতেই মৃত্যু নামক সেতু
দিয়ে মুমিনচিত্ত তার
প্রেমাস্পদের কাছে চলে যেতে পারে। মৃত্যুর
মাধ্যমে পরকালের জীবন শুরু
হয়।
আখেরাতের প্রথম ধাপ
হচ্ছে বরযখ বা কবরের জীবন।
আর সেই আখেরাতের নেয়ামত ও সুখশান্তি খোদাভীরু মানুষদের
জন্য প্রতীক্ষিত থাকে। যেমন এ
জাতীয় বহু আয়াতের
একটিতে মহান আল্লাহ্
তাআলা ইরশাদ করেন,
“আখেরাতের জীবনটা আমি প্রস’ত
রেখেছি সে বান্দাদের জন্য
যারা দুনিয়াতে না অহঙ্কার
প্রদর্শন করতে চায়, না বিপর্যয়
সৃষ্টি করতে, আখেরাত
তো মুত্তাকী (বা খোদাভীরু) বান্দাদের জন্য।” (২৮:৮৩)
যেখানে মুত্তাকী বান্দার জন্য
আখেরাতের সুখ সমৃদ্ধি,
সেখানে স্বয়ং নবী করীম (দ.) র
মর্যাদা কত উঁচু হবে, তার
কি ইয়ত্তা আছে? আল্লাহর বাণী “আপনার জন্য আখেরাত
তো দুনিয়া থেকে অবশ্যই অনেক
উত্তম। কোন নবীই নিজ সম্মতি ও
সন’ষ্টি ছাড়া পরকাল
যাত্রা করেন না।
আল্লাহর পক্ষ থেকে এটাই অমোঘ ও অবধারিত নিয়ম। আল্লাহ্
চাইলে তাই পরম আনন্দে ও
সন’ষ্টচিত্তে তাঁরা-তাঁর
আহ্বানকে আলিঙ্গন করবেন,
এটাই
স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত। এছাড়া মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেন
বলেই ঢালাও ভাবে নবীকুল
সম্রাটকে ‘মারা গেছেন’,
‘মরে গেছেন’, মৃত
নবী’ (নাউযুবিল্লাহ্) – এসব বিশেষণে উল্লেখ করা জঘন্য বে-
আদবী, তাঁর (দ.) মর্যাদার
পক্ষে চরম অবমাননাকর।
আমাদের নবী লোকান্তরে গমন
করেও হায়াতুন্নবী, এতে তাঁর
হায়াত’র মধ্যে কোন প্রভেদ আনে না। আমাদের
বিশ্বাসমতে এটা তাঁর শ্রেষ্ঠ
মর্যাদার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
যেদিন রাসুলে আকরাম (দ.) এ
পৃথিবী থেকে অন্তরাল
হয়ে ‘রফীকে আ’লা’ (বা সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গী)
মা’বুদে হাকীকীর একান্ত
সানিধ্যে গমন করবেন, “সেদিন
মসজিদে নববীতে ফজরের
নামাযের ইমামত করছিলেন
প্রধান খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাদি.)।
প্রিয় নবী (দ.)
মা আয়েশা সিদ্দীকা (রাদি)’র
প্রকোষ্টে রোগশয্যায়। দু’জন
সাহাবীর কাঁধে ভর
দিয়ে তিনি তাঁর কামরার দরজায়
এসে পর্দা সরিয়ে দেখলেন,
নামায যথারীতি শুরু হয়েছে।
হুজরায়ে রাসুল’র
পর্দা সরাতে সাহাবায়ে কেরাম
নবীজিকে দেখলেন এবং আনন্দে উৎফুল্ল
হয়ে ওঠলেন।
কারণ সবাই ভাবছেন
নবীজি নামায পড়াবেন। ইমাম
সিদ্দীকে আকবর (রাদি.) নিজেও
সরে যেতে উদ্যত হচ্ছিলেন; কিন’
উম্মতের জামাতসহ নামাযের এ
দৃশ্য মুগ্ধ নবীজি ইশারায়
তাঁদেরকে নামায
চালিয়ে যেতে বললেন, অতঃপর
পর্দা পড়ে গেল। সেদিনই প্রিয় নবীর ওফাত হয়।” হযরত আনাস
(রাদি.) র এ
বর্ণনা বুখারী শরীফেও
সংকলিত,
শাইখ আব্দুল হক
মুহাদ্দিসে দেহ্লভী স্বীয় গ্রনে’
একাধিক সূত্রে এ
মর্মে আরো বর্ণনা সংকলণ
করেন।
মালাকুল মাওত এসে আল্লাহর
রাসুলের খেদমতে হাজির হতে অনুমতি চাইলেন
এবং আল্লাহর আহ্বান ব্যক্ত
করলেন। প্রিয় নবী (দ.) ইরশাদ
করলেন, অপেক্ষা করো জিব্রীল
(আ.) আসুক। কিছুক্ষণ
পরে জিব্রাঈল (আ.) হাজির হলেন। নবীজি জানালেন,
জিব্রীল, আযরাঈল (আ.) আমার
‘রূহ’
আহরণের অনুমতি চাইছেন।
জিব্রীল, জানালেন,
ইয়া রাসুলাল্লাহ (দ.) আল্লাহ আপনাকে সালাম জানিয়েছেন,
তিনি আপনার জন্য উদগ্রীব।
আমাদের প্রিয় নবী (দ.) বললেন,
“যাওয়ার জন্য তো আমিও উম্মুখ,
তবে উদ্বেগ হল, আমার পরে এ
উম্মতের কী হবে? তখন জিব্রাঈল
(আ.) আরয করলেন, আল্লাহ্
তাআলা আপনার উম্মতের
বিষয়ে আপনার নয়ন শীতল
করবেন
বলে জানিয়েছেন। বলেছেন, যতক্ষণ আমার হাবীব ও
তাঁর উম্মত প্রবিষ্ঠ হবেন
না ততক্ষণ, আর সকলের জন্য
বেহেশত নিষিদ্ধ থাকবে। তাঁর
পবিত্র কিতাবে কি এ কথা নেই,
“আপনার প্রভু আপনাকে সন’ষ্ট করেই তৃপ্ত হবেন?”
এটা শুনে আমাদের প্রিয়
নবী বললেন, এখন আমার
প্রত্যাশা পূর্ণ হল, লোকান্তরিত
হতে আমার আত্মা পরিতুষ্ট হল।
এরপর তিনি আল্লাহর শুকরিয়া জানালেন।
অবশেষে “আল্লাহুম্মার
রাফীকাল
আ’লা” বলতে বলতে দু’চোখ
মুদে নিলেন। এটাই ছিল তাঁর
অন্তিম বাক্য। ইবনে কাসীর বলেন, “ইবনে ইসহাক ও
ওয়াকেদীর
বর্ণনামতে নবী করীম (দ.)
রবিউল আউয়াল শরীফের
বারো তারিখ সোমবার দিন
প্রত্যুষে ইন্তেকাল করেন। মঙ্গলবার রাতে তাঁকে সমাহিত
করা হয়। “ (বেদায়া নেহায়া)
আল্লামা হাফেজ এম. এ জলীল
(রহ.) ইমাম তকীউদ্দীন সুবফীর
শিফাউস সিকাম গ্রনে’র
বরাতে লিখেছেন, “হুযূর (দ.) এর দাফনের পর আল্লাহ্ তাআলা তাঁর
(দ.) পবিত্র ‘রূহ শরীফ’ দেহ
মোবারকে ফেরত পাঠিয়ে দেন,
তাই তিনি কিয়ামত পর্যন্ত
হায়াতুন্নবী’।
[নূর নবী (দ.) ] নবীগণের সম্মতি ও অনুমতি ছাড়া তাঁদের
রূহ কব্জ করা হয় না – এটাই
বিশুদ্ধ
ইসলামী আকীদা বিশ্বাস।
“আল্লাহ তা-লা তাঁদের দেহ
মোবারককে স্পর্শ করাও হারাম করে দিয়েছেন” –
এটা হাদীসে রাসুল বিধায় এ
বিশ্বাস বদ্ধমূল রাখা প্রত্যেক
মুমিনের উচিত।
এর বিপরীত কোন কথা বলে নবীর
মর্যাদা খাটো করার প্রয়াস নিঃসন্দেহে কুফরী। সর্বশ্রেষ্ঠ
নবী, প্রিয় নবী (দ.) সবসময়
হায়াতুন্নবী এ আকীদা পোষণ
করাই জরুরি। প্রিয় নবীর ওফাত
তাঁর হায়াতুন্নবী হওয়ার
অন্তরায় নয়। তাছাড়া তাঁর ওফাত
শরীফও অন্য কারো মৃত্যুর মত নয়।
রবিউল আউয়াল মাস তাঁর
আগমনের
মাস, তাই তাঁর ওফাত দিবস
বা মৃত্যু দিবস পালন, কিংবা শোকপালনের প্রস্তাব
বা পরামর্শ কোনটাই মুসলমানের
কাম্য হতে পারে না।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া
আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব :হযরত
খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.)
মাজার জামে মসজিদ।