কবর জিয়ারত -------------------------------------------
করব জিয়ারত এমন একটি শরীয়ত সমর্থিত বিধান যার মাধ্যমে কবর দেশের মানুষের সাথে জীবিতদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে। মৃতদের আত্মা খুশি হয় এবং জীবিতদের জন্য মৃত ব্যক্তিগণের নেক দোয়া নছীব হয়। মউতের কথা স্মরণ হয়, যার ফলে মানুষ অন্যায় আচরণ থেকে ফিরে আসে। ইহা মানুষকে সংযমী, খোদাভীরু ও চিন্তাশীল করে তোলে এবং পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যাদের অন্তরে পরকালের কথা স্মরণ হয় তারা নেক কাজ করতে উদ্যোগী হয় এবং পাপ কাজ হতে বিরত থাকে।
খোদ হযরত রাসূল আকরাম কবর জিয়ারত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে তিরমিজী শরীফ ১/১২৫ পৃষ্ঠায় হযরত বুরাইদা (রাঃ) হতে একটি হাদীস বর্ণিত আছে�
হযরত রাসূল মকবুল বলেছেন, আমি তোমাদেরকে করব জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। তোমরা শুন, মুহাম্মদ (সাঃ)কে তাঁর মাতার কবর জিয়ারত করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা কবর জিয়ারত করো। করব জিয়ারতে পরকালের কথা স্মরণ হয়।
হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূল মকবুল মায়ের কবর জিয়ারত করে কাঁদলেন এবং তাঁর সাথীগণকেও কাঁদালেন। অতঃপর বললেন, আমি আল্লাহপাকের দরবারে আমার মায়ের মাগফেরাতের দরখাস্ত করেছিলাম। আল্লাহপাক আমাকে উহার অনুমতি দিলেন না। জিয়ারত করার দরখাস্ত করলাম উহার অনুমতি পেলাম। ওহে ছাহাবাগণ! তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেননা কবর জিয়ারতে মওতের কথা স্মরণ হয়।
-আবু দাউদ শরীফ-২/৪৬১ পৃষ্ঠা মুসলিম শরীফ ১/৩১৪ পৃষ্ঠা।
কায়সের পুত্র মুহাম্মদ হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) বললেন, আমি তোমাদের নিকট আমার থেকে ও হযরত রাসূল করীম (সাঃ) হতে হাদীস বর্ণনা করবো? কায়েস বললেন, আমরা সকলে প্রতি উত্তরে বললাম, হ্যাঁ বলুন। অতঃপর হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমার জন্য নির্ধারিত রাতে যখন হযরত রাসূল পাক (সাঃ) আমার কাছে ছিলেন। তিনি আমার থেকে মোড় দিলেন শরীর থেকে চাদর এবং পায়ের জুতা খুলে উহা পায়ের নিকট রেখে দিলেন। লুঙ্গির এক পাশ বিছানায় বিছায়ে তার উপর কাঁত হয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনি ঐ অবস্থায় আমার নিদ্রা যাওয়ার সময় পর্যন্ত ছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে চাদর হাতে নিলেন, জুতা পরলেন, আস্তে আস্তে দরজা খুললেন এবং ঘর হতে বের হয়ে আস্তে দরজা চেপে দিলেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তখন কামীছ মাথায় পরলাম, উড়না পরলাম, তাহবন্দ পরলাম। অতঃপর তাঁর পেছনে পেছনে চলতে লাগলাম। তিনি জান্নাতুল বাকী এসে দাঁড়ালেন। তিনি সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। অতঃপর তিনি তিনবার হাত উঠায়ে দোয়া করে সেখান থেকে পশ্চাদপদ হন। আমিও পশ্চাদমুখী হলাম। তিনি দ্রুত চলতে থাকলে আমিও দ্রুত চলতে থাকি। তিনি দৌড়ালে আমিও দৌড়াতে থাকি। এমনিভাবে আমি তাঁর আগে ঘরে ঢুকে পড়ি এবং বিছানায় কাঁত হয়ে শুয়ে পড়া ব্যতীত আর কিছুই করিনি।
অতঃপর রাসূল মকবুল ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আয়েশা, নম্র ভাষিণী সদাচারিণী বলো তোমার কি হয়েছে? হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রতি উত্তরে বললেন কিছুই হয়নি। তদুত্তরে হুজুর আকরাম বললেন, যা-ই হয়েছে সে সম্পর্কে তুমি আমাকে অবগত করে নচেৎ মহান আল্লাহ আমাকে সে সম্পর্কে অবগত করাবেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার বাপ-মা আপনার উপর কুরবান হোক এ বলে আমি তাঁকে অবহিত করলাম। হুজুর (রাঃ) বললেন, আমার সম্মুখ ভাগে যে শরীরটি দেখেছি উহা কি তুমিই? হযরত আয়েশা উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। তা শুনে হযরত রাসূল (সাঃ)কে তাঁর বক্ষের সাথে মিলিয়ে এমনিভাবে চাপ দিলেন যদ্বরুন আমি ব্যথা অনুভব করলাম। অতঃপর রাসূল তোমার উপর জুলুম করেন? এতদশ্রবণে হযরত আয়েশা বললেন, মানুষ যখনই যা কিছু গোপন করে তা আল্লাহপাক জানেন। হুজুর আকরাম বললেন হ্যাঁ! ব্যাপার হলো হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আগমন করেন ঐ সময়ে যখন তুমি আমাকে ঘরে দেখেছ। তিনি তখন আমাকে তোমার থেকে গোপন করে ডাকলেন। আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি এবং এটা তোমার হতে গোপন করেছি। তোমার শরীরের কাপড় রেখে দিয়েছিলে বিধায় তিনি তোমার নিকট প্রবেশ করেননি। আমি ধারণা করছি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ তাই তোমাকে জাগ্রত করা অপছন্দ করেছি এবং আমার আশঙ্কা ছিলো যে, তুমি বিব্রত ও ভীত হয়ে পড়বে।
অতঃপর জিব্রাঈল (আঃ) বললেন, হে নবী! আপনার প্রভুর নির্দেশ, জান্নাতুল বাকীর মৃতদের নিকট গিয়ে তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট মাগফিরাত কামনা করবেন। তা� শুনে হযরত রাসূল আকরাম (রাঃ)কে হযরত আয়েশা জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি তাদের জন্য কি বলবো। তদুত্তরে বললেন, ওহে আয়েশা! তুমি বলো�
সালাম হে কবরবাসী মুমিন মুসলমানদের প্রতি, মহান আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। আর আল্লাহপাক চাহেনতো আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে আবু দাউদ শরীফে ২/৪৬১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে�
হযরত রাসূল আকরাম (রাঃ) কবরস্থানের দিকে বের হয়ে তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, ওহে কবরবাসী মুমীনগণ! তোমাদের উপর আল্লাহপাকের সালাম ও শান্তি বর্ষিত হোক। নিশ্চয়ই আমরাও আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় তোমাদের সাথে মিলিত হবো।
উল্লেখিত হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হলো, হযরত রাসূল মকবুল আল্লাহ তায়ালার তরফ হতে উম্মতগণের কবর জিয়ারত করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিলেন। তাই তিনি জান্নাতুল বাকী ও অন্যান্য কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করেছেন এবং উম্মতগণকেও কবর জিয়ারত করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।
মুছান্নাফে এবনে আবী শায়বায় বর্ণিত আছে�
হযরত রাসূল মকবুল প্রতি বছর ওহুদ প্রান্তরে শহীদানদের কবরস্থানে এসে বলতেন, হে শহীদগণ! তোমাদের প্রতি মহান আল্লাহর শান্তি নাযিল হোক, যেহেতু তোমরা আল্লাহ পাকের রাহে ধৈর্য ধারণ করেছ। তোমাদের এ বাড়ির অবস্থা কতই না উত্তম।
সুনানে বায়হাকী ৫/২৪৯ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে�
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত রাসূল মকবুল যখন তাঁর নিকট রাত্রি যাপন করতেন, শেষ রাত্রিতে তিনি তাঁর কাছ থেকে বের হয়ে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে বলতেন, হে কবরবাসী মুমীনগণ! আপনাদের প্রতি সালাম। আমরা আপনাদের জন্য ভবিষ্যতের অঙ্গীকারগুলোর আশা করি। আর আমরা আল্লাহপাক চাহেত আপনাদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি। হে আল্লাহ! বাকীয়ে গায়কাদের বাসিন্দাদের ক্ষমা করুন।
এ সম্পর্কে বায়হাকী শরীফে মুহাম্মদ বিন নো�মান হতে বর্ণিত আছে�
হযরত রাসূল মকবুল বলেছেন, যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অথবা যে কোনো একজনের প্রত্যেক জুময়ার দিনে জিয়ারত করবে তার সমস্ত পাপ মাফ করা হবে এবং তার নাম নেককারের দফতরে লিপিবদ্ধ করা হবে। ইবনে আবিদ্দুনিয়া ও ইমাম বায়হাকী শো�য়াবুলঈমান কিতাবে মুহাম্মদ বিন ওয়াছে হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন আমার নিকট এ মর্মে হাদীস পৌঁছেছে যে, মৃত ব্যক্তিগণ সপ্তাহে তিন দিন অর্থাৎ বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার জিয়ারতকারীদের চিনেন। আল্লামা ইবনে কাইউম বলেন, হাদীস সমূহ হতে প্রতীয়মান হয় যে, জিয়ারতকারী যখনই গোরস্থানে আসে ও সালাম দেয় কবরবাসী তার সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে যায়, তার সালাম শুনে ও তাকে মহব্বত করে তার সালামের উত্তর দেয়। ইহা সকল মৃতদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। চাই মৃত ব্যক্তি শহীদ হোক বা সাধারণ মানুষ হোক এবং এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দিন বা সময়ের প্রশ্ন নেই। ইহা সর্বদা হতে পারে। (মারাকিল ফালাহ ৩৪২ পৃষ্ঠা)
হাশিয়ায়ে তাহতাবী কিতাবের ৩৬৩ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে�
জিয়ারতের জন্য মুস্তাহাব হলো সূরায়ে ইয়াসীন পাঠ করা। কেননা, হযরত আনাস (রাঃ) হতে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূল মকবু বলেছেন, যে ব্যক্তি কবরস্থানে প্রবেশ করে সূরায়ে ইয়াসীন পাঠ করতঃ উহার ছওয়াব মৃতদেরকে হাদিয়া দেন। মহান আল্লাহ ঐদিন ঐ করবস্থানের মৃতদের আযাব হাল্কা করতঃ বন্ধ করে দেন। এরূপ জুময়ার দিনের জিয়ারতে কবরবাসীদের আযাব বন্ধ করে দেন এবং পুনঃ তাদের প্রতি আযাব প্রত্যাবর্তন করে না। মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যানুযায়ী জিয়ারতকারীকে ইওয়াব ও নেকী দেয়া হয়। ইমাম যায়লায়ীর বর্ণনা ও অনুরূপ।
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি হযরত রাসূল মকবুল-এর খেদমতে আরজ করেন যে, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের মৃত ব্যক্তিগণের পক্ষ থেকে দান-খয়রাত করবো কি? তাদের পক্ষ থেকে হজ্ব করবো কি? তাদের জন্য দোয়া করবো কি? আমাদের দান খয়রাত, হজ্ব ও দোয়া কি মৃতদের নিকট পৌঁছে। তদুত্তরে হজুর আকরাম বললেন হ্যাঁ, উহার ছওয়াব মৃতদেহের নিকট পৌঁছে এবং মৃত ব্যক্তিগণ উহাতে খুশি হন। যেমন তোমাদের কেহ হাদিয়া ভর্তি পাত্র পেয়ে খুশি হয়।
ইমাম যায়লায়ী অধ্যায়ে হযরত আলী (রাঃ) হতে হাদীস বর্ণনা করেন, হযরত রাসূল মকবুল বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি কবরস্থানে প্রবেশ করে ১১ বার সূরা এখলাছ পাঠ করে অতঃপর উহার ছওয়াব মৃতদেরকে হাদিয়া দেন তাহলে ঐ ব্যক্তির আমল নামাজ মৃতদের সংখ্যানুপাতে নেকী দেয়া হয়। দারুকুতনী, ইবনে আবী শায়বা হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি কবরস্থানে প্রবেশ করে আর বলে, হে আল্লাহ! যিনি ধ্বংসশীল শরীর ও ছিন্ন বিছিন্ন হাড্ডি সমূহের মালিক যা দুনিয়া হতে বের হয়ে এসেছে এসব বান্দা আপনার প্রতি বিশ্বাসী আপনি তাদের প্রতি আপনার শান্তি এবং আমার পক্ষ হতে সালাম পৌঁছে দিন। এভাবে দোয়া করলে তার জন্য প্রত্যেক মুমিন বান্দা ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যারা হযরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির পর হতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
মৃত ব্যক্তিগণ জিয়ারতকারীকে চিনেন ও দোয়া করেন
মুখতারাতুন নাওয়াযিল কিতাবে লিখিত আছে, প্রতি সপ্তাহে জিয়ারত করা যায়। শরহে লোবাবে লিখিত আছে, জুমায়াবার, শনিবার, সোমবার ও বৃহস্পতিবার জিয়ারত করা উত্তম। মুহাম্মদ বিন ওয়াসেহ বলেছেন, বৃহস্পতিবার, জুমায়াবার ও শনিবার এ তিনদিন মৃত ব্যক্তিগণ জিয়ারতকারীগণকে চিনেন। এতে প্রমাণিত হলো, জিয়ারতের উত্তম দিন হচ্ছে শুক্রবার। ঐ কিতাবে আরো লিখিত আছে যে, ওহুদ পাহাড়ে সমাহিত শহীদানদের কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব। মুছান্নিফে ইবনে আবী শায়বায় বর্ণিত আছে, নবী করমি ওহুদের শহীদানের কবর জিয়ারত করার জন্য প্রতি বছরের প্রারম্ভে এসে বলতেন, তোমাদের প্রতি আল্লাহপাকের শান্তি বর্ষিত হোক, যেহেতু তোমরা আল্লাহপাকের রাহে ধৈর্য ধারণ করেছ। তোমাদের বাসস্থানের অবস্থা কতই না সুন্দর! তবে উত্তম হচ্ছে, ওহুদের শহীদদের জিয়রত করার জন্য বৃহস্পতিবার ভোরে পাক-পবিত্র হয়ে আসা, যাতে জিয়ারত করে মসজিদে নববীতে জোহরের নামাজ জামায়াত সহকারে পড়া যায়।
আল্লামা শামী বলেছেন, বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো, কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব, যদিও উহা বাড়ি হতে বহু দূরে অবস্থিত হয়। উল্লেখ্য যে, যদি কবরস্থান দূরে হয়, সেখানে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে বা যানবাহনের মাধ্যমে সফর করা যাবে কি না? যেমন মানুষ সচরাচর হযরত ইব্রাহীম খলিল, তার পরিবারস্থ লোকদের ও বদর যুদ্ধের শহীদদের সরদার হযরত হামযা ও অন্যান্য শহীদানের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করে থাকে এ সম্পর্কে শামী বলেন, আমাদের ইমামগণের কাউকে এমন দেখিনি যিনি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেছেন। তাই শাফেয়ী মাযহাবের কোনো কেনো ইমাম এ উদ্দেশ্যে সফর করা মুস্তাহাব নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তবে হযরত রাসূল মকবুল এর জিয়ারতে যানবাহনযোগে যাওয়া মুস্তাহাব লিখেছেন। সুতরাং অন্যান্য নবী-ওলী ও সাধারণ মুমিনদের জিয়ারতে সফর নিষিদ্ধ হবে। যেহেতু প্রসিদ্ধ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে যাওয়া নিষিদ্ধ। উহার খণ্ডন নিম্নরূপ ঃ
হযরত রাসূল মকবুল-এর বাণী, তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে নামাজ পড়ে ফজিলত হাসিল করার জন্য যানবাহনযোগে যেও না। কারণ, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকছা এ তিনটি মসজিদে নামাজের ফজিলত হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে। তাছাড়া অন্য সকল মসজিদ যত সুন্দর বা আকারে বড় হোক না কেনো ফজিলত ও ছওয়াবের দিক দিয়ে সমান বিধায়, অন্য মসজিদে ফজিলত পাওয়ার জন্য সফর করা বা যানবাহনযোগে যাওয়া মুস্তাহাব নয়। ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এ পার্থক্য বর্ণনা করেছেন। এরূপ রদ্দুস মুহতাব ১/১৪৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
প্রকাশ থাকে যে, বর্ণিত হাদীসের কবর জিয়ারতের সাথে কোনো সম্পর্কই নেই। যেমন ফয়জুল বারী শরহে বুখারী ২য় খণ্ড ৪৩৩ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে�
যেহেতু মুসনাদে আহমদে লিখিত আছে, হযরত নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, তোমরা নামাজ পড়ার জন্য কোনো মসজিদের দিকে সফর করবে না তিনটি মসজিদ ছাড়া।
উক্ত হাদীস হতে প্রমাণিত হলো সফর নিষেধ মসজিদের উপরা কবর জিয়ারতের উপর নয়। অর্থাৎ তোমরা নামাজের উদ্দেশ্যে কোনো মসজিদের দিকে যানবাহনযোগে যেও না, যদি যেতে হয় তাহলে এ তিনটি মসজিদ যথা মসজিদে হারাম, মসজিদে আকসা ও মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ার জন্য যানবাহনযোগে যাও। কারণ, মসজিদে হারামে প্রতি রাকয়াতে এক লক্ষ রাকয়াতের ছওয়াব আর মসজিদে আকসা ও মসজিদে নববীতে প্রতি রাকয়াতে পঞ্চাশ হাজার রাকয়াতের ছওয়াব পাওয়া যাবে। এছাড়া অন্যান্য সকল মসজিদে নামাজ পড়ার ছওয়াব সমান। কাজেই নামাজের উদ্দেশ্যে কোনো মসজিদে যানবাহনযোগে সফরের প্রয়োজন নেই। জানা আবশ্যক, অত্র হাদীসটি কবর জিয়ারতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না বিধায়, যারা জিয়ারতের ক্ষেত্রে এ হাদীসটি দলিল হিসেবে পেশ করেন উহা বাতিল বলে গণ্য হলো। যেমন�হযরত শাহ্ আনোয়ার কাশমীরী তদীয় গ্রন্থে এ মন্তব্য করেছেন।
আওলিয়ায়ে কেরামের কবর জিয়ারত প্রসঙ্গ
তবে আওলিয়ায়ে কেরাম মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের দিক দিয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য ও তফাৎ বিদ্যমান। জিয়ারতকারীগণও উপকৃত হওয়ার দিক দিয়ে তাদের মা'রেফাত ও আসরার হিসেবে শ্রেণী বিভাগে বিভক্ত। আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী তদীয় ফাতাওয়ার কিতাবে বলেছেন যে, যদি আওলিয়ায়ে কেরামের মাজারের নিকট শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ, ফিতনা-ফাসাদ পরিলক্ষিত হয় যথা-মেয়ে পুরুষের সমাবেশ, সিজদা, গান-বাজনা ইত্যাদি তজ্জন্য জিয়ারত হতে বিরত থাকা যাবে না। কেননা, এসব অজুহাতে নৈকট্য লাভের বস্তুকে পরিত্যাগ করা যায় না বরং মাুনষের উচিত জিয়ারতে বিদয়াতের বিরোধিতা করা এবং সম্ভব হলে তা মুলোচ্ছেদ করা। আল্লামা ইবনে হাজর বলেন, উক্ত মতের সমর্থনে বলা যায় যে, জানাজার পেছনে কবর পর্যন্ত যাওয়া পরিত্যাগ করা যাবে না যদিও উহার সাথে ক্রন্দনকারিনী মহিলাগণ থাকে। (এ কথায় কোনো দ্বিমত নেই)। দুররে মুখতার ও রদ্দুল মুহতার ১/৮৪৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
কবর জিয়ারতের আদব
ফতহুল কাদীর গ্রন্থে লিখিত আছে যে, দাঁড়িয়ে জিয়ারত করা সুন্নাত জিয়ারত করার পর দাঁড়িয়ে দোয়া ও মোনাজাত করা সুন্নাত। কেননা, হযরত রাসূল আকরাম জান্নাতুল বাকীতে জিয়ারতকালে এরূপ করেছেন। আরো বলেছেন, আস্সালামু আলাইকুম দারা কাওমিম্ মুমিনীন। ওয়া ইন্না ইনশা আল্লাহু বিকুম লাহেকুন। মুল্লা আলী কারী শরহে লোবাবে লিখেছেন, ফোকহায়ে কেরাম আদবে জিয়ারত সম্পর্কে বলেছেন, মৃত ব্যক্তির পায়ের নিকটে জিয়ারতকারী দাঁড়াবে। মাথার নিকটে নয়, কেননা তাতে মৃত ব্যক্তির জিয়ারতকারীকে দেখতে কষ্ট হয়, পায়ের নিকট দাঁড়ালে মৃত ব্যক্তির চোখ বরাবর হয়। তবে এ পদ্ধতি তখনই আমল করা যাবে যখন পায়ের নিকট দাঁড়ানো সম্ভব হবে। যেহেতু হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূল করীম মৃত ব্যক্তির নিকট দাঁড়িয়ে সূরা বাকারা এবং পায়ের নিকট সূরায়ে বাকারার শেষ অংশ পড়েছেন। কবর জিয়ারতের আদবের মধ্যে ইহাও আছে, ছহীহ কাওল মতে, ...বলবে। যেহেতু হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, হুজুর পাক জিয়ারতে বলেছেন�
অতঃপর দাঁড়ানো অবস্থায় লম্বা দোয়া করবে। আর যদি বসে জিয়ারত করতে চায় তাহলে ঐ লোকের জীবদ্দশায় তার সম্মানে যতদূর নিকটে বা দূরে বসেছে ততটুকু দূরে বা নিকটে বসবে। সূরায়ে ইয়াসীন পড়তে তাতে আল্লাহপাক যত মৃত ব্যক্তি ঐ কবরস্থানে আছে তাদের সংখ্যানুপাতে নেকী দেবেন এবং তাদের আযাব হাল্কা করবেন। শরহে লুবাবে আছে জিয়ারতকারীর পক্ষে যা পাঠ করা সম্ভব যেমন, সূরায়ে ফাতিহা, বাকারা...মুফলেহুন পর্যন্ত, আয়াতুল কুরছি, আমানার রাসূলু, সূরা ইয়াসীন, সূরা মুলক, তাকাছুর, এখলাছ ১২ বার, ১১ বার, ৭ বার, ৩ বার পড়ে বলবে, হে খোদা আমি যা কিছু সূরা কিরাত পড়লাম উহার ছওয়াব এই মৃত ব্যক্তিদের নিকট পৌঁছে দিন। (শামী ১/৮৪৪ পৃষ্ঠা)।
মারাকিল ফালাহ গ্রন্থের ২৪২ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে, শরহুল মিশকাত গ্রন্থে আছে, জিয়ারতকারী কবরবাসীর জীবদ্দশায় তার সম্মানে যতটুকু নিকটে বা দূরে দাঁড়াত বা বসত তেমনিভাবে জিয়ারত করার সময়ও দাঁড়াবে বা বসবে। এরূপ অন্যান্য ফকীহগণও উল্লেখ করেছেন।
কুহেস্তানী গ্রন্থে লিখিত আছে যে, জিয়ারতকারী কবরবাসীর সম্মুখে এভাবে দাঁড়াবে যেরূপ জীবিত কালে সামনে দূরে বা নিকটে দাঁড়াত। এহইয়াউল উলুম কিতাবে লিখিত আছে, কবর জিয়ারত কালে মুস্তাহাব তরীকা হলো কিবলোকে পেছনে রেখে মাইয়্যেতের চেহারামুখী হয়ে দাঁড়াবে, সালাম দেবে। কবর স্পর্শ করবে না বা চুম্বন করবে না ও কবরকে মাসেহ করবে না এসব করা নাছারাদের অভ্যাস। অনুরূপ বর্ণনা শরহুশ শেরআত কিতাবে আছে। শরহুল মিশকাতে আছে যে, মুস্তাহাব তরীকা হলো, মৃতদের উপর সালাম দেয়ার সময় তাদের সম্মুখীন হয়ে সালাম প্রদান করা এবং ঐ অবস্থায় মাইয়্যেতের দিকে মুখ করে দোয়া করা। মুসলিম সমাজে এ তরীকাই প্রচলিত।
এবনে হাজর আসকলানী শাফেয়ী বলেছেন, এরূপ করা মুস্তাহাব নয়। ইজতেযকার ও তামহীদ কিতাবে ছহীহ সনদের সাথে এবনে আব্দুল বর হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন, হযরত রাসূল মকবুল বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে থাকে সে দুনিয়ায় তাকে চিনতো, এমতাবস্থায় সালাম করলে উক্ত মৃত ব্যক্তি সালামদাতাকে চিনে তার সালামের জবাব দিয়ে দেয়। (মারাকিল ফালাহ ৩৪২ পৃষ্ঠা)
কবর জিয়ারতের পবিত্র কুরআন পাঠ
করলে উহার ছওয়াব মৃত ব্যক্তি পায়
হেদায়া গ্রন্থের অধ্যায়ে ওলামায়ে হানাফিয়া অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, মানুষ নামাজ, রোজা ছদকা আরো অন্যান্য এবাদত করে উহার ছাওয়াব যদি অপরকে প্রদান করেন করতে পারেন। এতে কোনো আপত্তি নেই। মুহীত কিতাব হতে তাতার খানিয়া গ্রন্থে যাকাত অধ্যায়ে লিখিত আছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি নফল ছদ্কায় সারা পৃথিবীর মুসলিম নর-নারীর নিয়্যাত করে উহা উত্তম হয়, উক্ত ছওয়াব তাদের আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে। তাতে ছদ্কাদাতার ছওয়াব কম হবে না। ইহা আহলে সুন্নাতুল জামায়াতের অভিমত। তবে ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন যে, শুধু শারীরিক ইবাদত যথা নামাজ ও তিলাওয়াতে কুরআন= এর ছওয়াব মৃত ব্যক্তিকে প্রদান করলে উহা মৃতগণ পাবেন না। হ্যাঁ, নফল ছদকা ও হজ্বের ছওয়াব দান করলে উহা মৃত ব্যক্তিগণ পাবেন। মো�তাযিলা বাতিল ফেরকার অভিমত হলো যে, কোনো প্রকারের দান খয়রাতের ছওয়াব মৃতদের নিকট পৌঁছে না। এরূপ ফতহুল কাদীর গ্রন্থে বর্ণিত আছে।
আল্লামা শামী বলেন, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-এর যে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে, উহা সর্বজন বিদিত মত। তবে ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-এর পরবর্তী অনুসারীগণ যা ব্যক্ত করেছেন তা হলো মৃত ব্যক্তির নিকট দাঁড়িয়ে বা বসে সূরা কিরাত পাঠ করলে অথবা কিরাতের পর তার জন্য দোয়া করা হলে উহার ছওয়াব তার রূহে পৌঁছে। যদি সে দূরে তথা অদৃশ্য হয়। কেননা, তিলাওয়াতের স্থানে বরকত ও রহমত নাযিল হয় এবং কুরআন শরীফ তিলাওয়াত অন্তে দোয়া করলে উক্ত দোয়া কবুলের আশা বেশি। এতে ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন পাক তিলাওয়াত অন্তে তারা দোয়া করেন এভাবে যে, ওহে আল্লাহ! আমি যা কুরআন পাক হতে পড়লাম, উহার ন্যায় উপকার অমুক ব্যক্তিকে পৌঁছান। কিন্তু আমাদের আয়েম্মায়ে হানাফিয়াদের মতে, মৃত ব্যক্তির নিকট কুরআন পাঠের ছওয়াব পৌঁছে।
বাহরুর রায়েক কিতাবে আছে, কোনো ব্যক্তি যদি রোজা রাখে, নামাজ পড়ে অথবা ছদকা করে, আর উক্ত রোজা, নামাজ ও ছদকা খয়রাতের ছওয়াব মৃত ও জীবিত ব্যক্তিদেরকে দান করে উহা জায়েয এবং ঐ রোজা, নামাজ, ছদকার ছওয়াব মৃতদের আমলনামায় পৌঁছে যায়। এটাই আহলে সুন্নাতুল জামাতের মত। এরূপ বাদায়ে কিতাবে লিখিত আছে। শামী ১/৮৪৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য
করব জিয়ারত এমন একটি শরীয়ত সমর্থিত বিধান যার মাধ্যমে কবর দেশের মানুষের সাথে জীবিতদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে। মৃতদের আত্মা খুশি হয় এবং জীবিতদের জন্য মৃত ব্যক্তিগণের নেক দোয়া নছীব হয়। মউতের কথা স্মরণ হয়, যার ফলে মানুষ অন্যায় আচরণ থেকে ফিরে আসে। ইহা মানুষকে সংযমী, খোদাভীরু ও চিন্তাশীল করে তোলে এবং পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যাদের অন্তরে পরকালের কথা স্মরণ হয় তারা নেক কাজ করতে উদ্যোগী হয় এবং পাপ কাজ হতে বিরত থাকে।
খোদ হযরত রাসূল আকরাম কবর জিয়ারত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে তিরমিজী শরীফ ১/১২৫ পৃষ্ঠায় হযরত বুরাইদা (রাঃ) হতে একটি হাদীস বর্ণিত আছে�
হযরত রাসূল মকবুল বলেছেন, আমি তোমাদেরকে করব জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। তোমরা শুন, মুহাম্মদ (সাঃ)কে তাঁর মাতার কবর জিয়ারত করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা কবর জিয়ারত করো। করব জিয়ারতে পরকালের কথা স্মরণ হয়।
হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূল মকবুল মায়ের কবর জিয়ারত করে কাঁদলেন এবং তাঁর সাথীগণকেও কাঁদালেন। অতঃপর বললেন, আমি আল্লাহপাকের দরবারে আমার মায়ের মাগফেরাতের দরখাস্ত করেছিলাম। আল্লাহপাক আমাকে উহার অনুমতি দিলেন না। জিয়ারত করার দরখাস্ত করলাম উহার অনুমতি পেলাম। ওহে ছাহাবাগণ! তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেননা কবর জিয়ারতে মওতের কথা স্মরণ হয়।
-আবু দাউদ শরীফ-২/৪৬১ পৃষ্ঠা মুসলিম শরীফ ১/৩১৪ পৃষ্ঠা।
কায়সের পুত্র মুহাম্মদ হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) বললেন, আমি তোমাদের নিকট আমার থেকে ও হযরত রাসূল করীম (সাঃ) হতে হাদীস বর্ণনা করবো? কায়েস বললেন, আমরা সকলে প্রতি উত্তরে বললাম, হ্যাঁ বলুন। অতঃপর হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমার জন্য নির্ধারিত রাতে যখন হযরত রাসূল পাক (সাঃ) আমার কাছে ছিলেন। তিনি আমার থেকে মোড় দিলেন শরীর থেকে চাদর এবং পায়ের জুতা খুলে উহা পায়ের নিকট রেখে দিলেন। লুঙ্গির এক পাশ বিছানায় বিছায়ে তার উপর কাঁত হয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনি ঐ অবস্থায় আমার নিদ্রা যাওয়ার সময় পর্যন্ত ছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে চাদর হাতে নিলেন, জুতা পরলেন, আস্তে আস্তে দরজা খুললেন এবং ঘর হতে বের হয়ে আস্তে দরজা চেপে দিলেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তখন কামীছ মাথায় পরলাম, উড়না পরলাম, তাহবন্দ পরলাম। অতঃপর তাঁর পেছনে পেছনে চলতে লাগলাম। তিনি জান্নাতুল বাকী এসে দাঁড়ালেন। তিনি সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। অতঃপর তিনি তিনবার হাত উঠায়ে দোয়া করে সেখান থেকে পশ্চাদপদ হন। আমিও পশ্চাদমুখী হলাম। তিনি দ্রুত চলতে থাকলে আমিও দ্রুত চলতে থাকি। তিনি দৌড়ালে আমিও দৌড়াতে থাকি। এমনিভাবে আমি তাঁর আগে ঘরে ঢুকে পড়ি এবং বিছানায় কাঁত হয়ে শুয়ে পড়া ব্যতীত আর কিছুই করিনি।
অতঃপর রাসূল মকবুল ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আয়েশা, নম্র ভাষিণী সদাচারিণী বলো তোমার কি হয়েছে? হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রতি উত্তরে বললেন কিছুই হয়নি। তদুত্তরে হুজুর আকরাম বললেন, যা-ই হয়েছে সে সম্পর্কে তুমি আমাকে অবগত করে নচেৎ মহান আল্লাহ আমাকে সে সম্পর্কে অবগত করাবেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার বাপ-মা আপনার উপর কুরবান হোক এ বলে আমি তাঁকে অবহিত করলাম। হুজুর (রাঃ) বললেন, আমার সম্মুখ ভাগে যে শরীরটি দেখেছি উহা কি তুমিই? হযরত আয়েশা উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। তা শুনে হযরত রাসূল (সাঃ)কে তাঁর বক্ষের সাথে মিলিয়ে এমনিভাবে চাপ দিলেন যদ্বরুন আমি ব্যথা অনুভব করলাম। অতঃপর রাসূল তোমার উপর জুলুম করেন? এতদশ্রবণে হযরত আয়েশা বললেন, মানুষ যখনই যা কিছু গোপন করে তা আল্লাহপাক জানেন। হুজুর আকরাম বললেন হ্যাঁ! ব্যাপার হলো হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আগমন করেন ঐ সময়ে যখন তুমি আমাকে ঘরে দেখেছ। তিনি তখন আমাকে তোমার থেকে গোপন করে ডাকলেন। আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি এবং এটা তোমার হতে গোপন করেছি। তোমার শরীরের কাপড় রেখে দিয়েছিলে বিধায় তিনি তোমার নিকট প্রবেশ করেননি। আমি ধারণা করছি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ তাই তোমাকে জাগ্রত করা অপছন্দ করেছি এবং আমার আশঙ্কা ছিলো যে, তুমি বিব্রত ও ভীত হয়ে পড়বে।
অতঃপর জিব্রাঈল (আঃ) বললেন, হে নবী! আপনার প্রভুর নির্দেশ, জান্নাতুল বাকীর মৃতদের নিকট গিয়ে তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট মাগফিরাত কামনা করবেন। তা� শুনে হযরত রাসূল আকরাম (রাঃ)কে হযরত আয়েশা জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি তাদের জন্য কি বলবো। তদুত্তরে বললেন, ওহে আয়েশা! তুমি বলো�
সালাম হে কবরবাসী মুমিন মুসলমানদের প্রতি, মহান আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। আর আল্লাহপাক চাহেনতো আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে আবু দাউদ শরীফে ২/৪৬১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে�
হযরত রাসূল আকরাম (রাঃ) কবরস্থানের দিকে বের হয়ে তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, ওহে কবরবাসী মুমীনগণ! তোমাদের উপর আল্লাহপাকের সালাম ও শান্তি বর্ষিত হোক। নিশ্চয়ই আমরাও আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় তোমাদের সাথে মিলিত হবো।
উল্লেখিত হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হলো, হযরত রাসূল মকবুল আল্লাহ তায়ালার তরফ হতে উম্মতগণের কবর জিয়ারত করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিলেন। তাই তিনি জান্নাতুল বাকী ও অন্যান্য কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করেছেন এবং উম্মতগণকেও কবর জিয়ারত করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।
মুছান্নাফে এবনে আবী শায়বায় বর্ণিত আছে�
হযরত রাসূল মকবুল প্রতি বছর ওহুদ প্রান্তরে শহীদানদের কবরস্থানে এসে বলতেন, হে শহীদগণ! তোমাদের প্রতি মহান আল্লাহর শান্তি নাযিল হোক, যেহেতু তোমরা আল্লাহ পাকের রাহে ধৈর্য ধারণ করেছ। তোমাদের এ বাড়ির অবস্থা কতই না উত্তম।
সুনানে বায়হাকী ৫/২৪৯ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে�
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত রাসূল মকবুল যখন তাঁর নিকট রাত্রি যাপন করতেন, শেষ রাত্রিতে তিনি তাঁর কাছ থেকে বের হয়ে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে বলতেন, হে কবরবাসী মুমীনগণ! আপনাদের প্রতি সালাম। আমরা আপনাদের জন্য ভবিষ্যতের অঙ্গীকারগুলোর আশা করি। আর আমরা আল্লাহপাক চাহেত আপনাদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি। হে আল্লাহ! বাকীয়ে গায়কাদের বাসিন্দাদের ক্ষমা করুন।
এ সম্পর্কে বায়হাকী শরীফে মুহাম্মদ বিন নো�মান হতে বর্ণিত আছে�
হযরত রাসূল মকবুল বলেছেন, যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অথবা যে কোনো একজনের প্রত্যেক জুময়ার দিনে জিয়ারত করবে তার সমস্ত পাপ মাফ করা হবে এবং তার নাম নেককারের দফতরে লিপিবদ্ধ করা হবে। ইবনে আবিদ্দুনিয়া ও ইমাম বায়হাকী শো�য়াবুলঈমান কিতাবে মুহাম্মদ বিন ওয়াছে হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন আমার নিকট এ মর্মে হাদীস পৌঁছেছে যে, মৃত ব্যক্তিগণ সপ্তাহে তিন দিন অর্থাৎ বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার জিয়ারতকারীদের চিনেন। আল্লামা ইবনে কাইউম বলেন, হাদীস সমূহ হতে প্রতীয়মান হয় যে, জিয়ারতকারী যখনই গোরস্থানে আসে ও সালাম দেয় কবরবাসী তার সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে যায়, তার সালাম শুনে ও তাকে মহব্বত করে তার সালামের উত্তর দেয়। ইহা সকল মৃতদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। চাই মৃত ব্যক্তি শহীদ হোক বা সাধারণ মানুষ হোক এবং এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দিন বা সময়ের প্রশ্ন নেই। ইহা সর্বদা হতে পারে। (মারাকিল ফালাহ ৩৪২ পৃষ্ঠা)
হাশিয়ায়ে তাহতাবী কিতাবের ৩৬৩ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে�
জিয়ারতের জন্য মুস্তাহাব হলো সূরায়ে ইয়াসীন পাঠ করা। কেননা, হযরত আনাস (রাঃ) হতে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূল মকবু বলেছেন, যে ব্যক্তি কবরস্থানে প্রবেশ করে সূরায়ে ইয়াসীন পাঠ করতঃ উহার ছওয়াব মৃতদেরকে হাদিয়া দেন। মহান আল্লাহ ঐদিন ঐ করবস্থানের মৃতদের আযাব হাল্কা করতঃ বন্ধ করে দেন। এরূপ জুময়ার দিনের জিয়ারতে কবরবাসীদের আযাব বন্ধ করে দেন এবং পুনঃ তাদের প্রতি আযাব প্রত্যাবর্তন করে না। মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যানুযায়ী জিয়ারতকারীকে ইওয়াব ও নেকী দেয়া হয়। ইমাম যায়লায়ীর বর্ণনা ও অনুরূপ।
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি হযরত রাসূল মকবুল-এর খেদমতে আরজ করেন যে, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের মৃত ব্যক্তিগণের পক্ষ থেকে দান-খয়রাত করবো কি? তাদের পক্ষ থেকে হজ্ব করবো কি? তাদের জন্য দোয়া করবো কি? আমাদের দান খয়রাত, হজ্ব ও দোয়া কি মৃতদের নিকট পৌঁছে। তদুত্তরে হজুর আকরাম বললেন হ্যাঁ, উহার ছওয়াব মৃতদেহের নিকট পৌঁছে এবং মৃত ব্যক্তিগণ উহাতে খুশি হন। যেমন তোমাদের কেহ হাদিয়া ভর্তি পাত্র পেয়ে খুশি হয়।
ইমাম যায়লায়ী অধ্যায়ে হযরত আলী (রাঃ) হতে হাদীস বর্ণনা করেন, হযরত রাসূল মকবুল বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি কবরস্থানে প্রবেশ করে ১১ বার সূরা এখলাছ পাঠ করে অতঃপর উহার ছওয়াব মৃতদেরকে হাদিয়া দেন তাহলে ঐ ব্যক্তির আমল নামাজ মৃতদের সংখ্যানুপাতে নেকী দেয়া হয়। দারুকুতনী, ইবনে আবী শায়বা হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি কবরস্থানে প্রবেশ করে আর বলে, হে আল্লাহ! যিনি ধ্বংসশীল শরীর ও ছিন্ন বিছিন্ন হাড্ডি সমূহের মালিক যা দুনিয়া হতে বের হয়ে এসেছে এসব বান্দা আপনার প্রতি বিশ্বাসী আপনি তাদের প্রতি আপনার শান্তি এবং আমার পক্ষ হতে সালাম পৌঁছে দিন। এভাবে দোয়া করলে তার জন্য প্রত্যেক মুমিন বান্দা ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যারা হযরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির পর হতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
মৃত ব্যক্তিগণ জিয়ারতকারীকে চিনেন ও দোয়া করেন
মুখতারাতুন নাওয়াযিল কিতাবে লিখিত আছে, প্রতি সপ্তাহে জিয়ারত করা যায়। শরহে লোবাবে লিখিত আছে, জুমায়াবার, শনিবার, সোমবার ও বৃহস্পতিবার জিয়ারত করা উত্তম। মুহাম্মদ বিন ওয়াসেহ বলেছেন, বৃহস্পতিবার, জুমায়াবার ও শনিবার এ তিনদিন মৃত ব্যক্তিগণ জিয়ারতকারীগণকে চিনেন। এতে প্রমাণিত হলো, জিয়ারতের উত্তম দিন হচ্ছে শুক্রবার। ঐ কিতাবে আরো লিখিত আছে যে, ওহুদ পাহাড়ে সমাহিত শহীদানদের কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব। মুছান্নিফে ইবনে আবী শায়বায় বর্ণিত আছে, নবী করমি ওহুদের শহীদানের কবর জিয়ারত করার জন্য প্রতি বছরের প্রারম্ভে এসে বলতেন, তোমাদের প্রতি আল্লাহপাকের শান্তি বর্ষিত হোক, যেহেতু তোমরা আল্লাহপাকের রাহে ধৈর্য ধারণ করেছ। তোমাদের বাসস্থানের অবস্থা কতই না সুন্দর! তবে উত্তম হচ্ছে, ওহুদের শহীদদের জিয়রত করার জন্য বৃহস্পতিবার ভোরে পাক-পবিত্র হয়ে আসা, যাতে জিয়ারত করে মসজিদে নববীতে জোহরের নামাজ জামায়াত সহকারে পড়া যায়।
আল্লামা শামী বলেছেন, বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো, কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব, যদিও উহা বাড়ি হতে বহু দূরে অবস্থিত হয়। উল্লেখ্য যে, যদি কবরস্থান দূরে হয়, সেখানে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে বা যানবাহনের মাধ্যমে সফর করা যাবে কি না? যেমন মানুষ সচরাচর হযরত ইব্রাহীম খলিল, তার পরিবারস্থ লোকদের ও বদর যুদ্ধের শহীদদের সরদার হযরত হামযা ও অন্যান্য শহীদানের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করে থাকে এ সম্পর্কে শামী বলেন, আমাদের ইমামগণের কাউকে এমন দেখিনি যিনি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেছেন। তাই শাফেয়ী মাযহাবের কোনো কেনো ইমাম এ উদ্দেশ্যে সফর করা মুস্তাহাব নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তবে হযরত রাসূল মকবুল এর জিয়ারতে যানবাহনযোগে যাওয়া মুস্তাহাব লিখেছেন। সুতরাং অন্যান্য নবী-ওলী ও সাধারণ মুমিনদের জিয়ারতে সফর নিষিদ্ধ হবে। যেহেতু প্রসিদ্ধ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে যাওয়া নিষিদ্ধ। উহার খণ্ডন নিম্নরূপ ঃ
হযরত রাসূল মকবুল-এর বাণী, তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে নামাজ পড়ে ফজিলত হাসিল করার জন্য যানবাহনযোগে যেও না। কারণ, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকছা এ তিনটি মসজিদে নামাজের ফজিলত হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে। তাছাড়া অন্য সকল মসজিদ যত সুন্দর বা আকারে বড় হোক না কেনো ফজিলত ও ছওয়াবের দিক দিয়ে সমান বিধায়, অন্য মসজিদে ফজিলত পাওয়ার জন্য সফর করা বা যানবাহনযোগে যাওয়া মুস্তাহাব নয়। ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এ পার্থক্য বর্ণনা করেছেন। এরূপ রদ্দুস মুহতাব ১/১৪৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
প্রকাশ থাকে যে, বর্ণিত হাদীসের কবর জিয়ারতের সাথে কোনো সম্পর্কই নেই। যেমন ফয়জুল বারী শরহে বুখারী ২য় খণ্ড ৪৩৩ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে�
যেহেতু মুসনাদে আহমদে লিখিত আছে, হযরত নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, তোমরা নামাজ পড়ার জন্য কোনো মসজিদের দিকে সফর করবে না তিনটি মসজিদ ছাড়া।
উক্ত হাদীস হতে প্রমাণিত হলো সফর নিষেধ মসজিদের উপরা কবর জিয়ারতের উপর নয়। অর্থাৎ তোমরা নামাজের উদ্দেশ্যে কোনো মসজিদের দিকে যানবাহনযোগে যেও না, যদি যেতে হয় তাহলে এ তিনটি মসজিদ যথা মসজিদে হারাম, মসজিদে আকসা ও মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ার জন্য যানবাহনযোগে যাও। কারণ, মসজিদে হারামে প্রতি রাকয়াতে এক লক্ষ রাকয়াতের ছওয়াব আর মসজিদে আকসা ও মসজিদে নববীতে প্রতি রাকয়াতে পঞ্চাশ হাজার রাকয়াতের ছওয়াব পাওয়া যাবে। এছাড়া অন্যান্য সকল মসজিদে নামাজ পড়ার ছওয়াব সমান। কাজেই নামাজের উদ্দেশ্যে কোনো মসজিদে যানবাহনযোগে সফরের প্রয়োজন নেই। জানা আবশ্যক, অত্র হাদীসটি কবর জিয়ারতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না বিধায়, যারা জিয়ারতের ক্ষেত্রে এ হাদীসটি দলিল হিসেবে পেশ করেন উহা বাতিল বলে গণ্য হলো। যেমন�হযরত শাহ্ আনোয়ার কাশমীরী তদীয় গ্রন্থে এ মন্তব্য করেছেন।
আওলিয়ায়ে কেরামের কবর জিয়ারত প্রসঙ্গ
তবে আওলিয়ায়ে কেরাম মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের দিক দিয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য ও তফাৎ বিদ্যমান। জিয়ারতকারীগণও উপকৃত হওয়ার দিক দিয়ে তাদের মা'রেফাত ও আসরার হিসেবে শ্রেণী বিভাগে বিভক্ত। আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী তদীয় ফাতাওয়ার কিতাবে বলেছেন যে, যদি আওলিয়ায়ে কেরামের মাজারের নিকট শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ, ফিতনা-ফাসাদ পরিলক্ষিত হয় যথা-মেয়ে পুরুষের সমাবেশ, সিজদা, গান-বাজনা ইত্যাদি তজ্জন্য জিয়ারত হতে বিরত থাকা যাবে না। কেননা, এসব অজুহাতে নৈকট্য লাভের বস্তুকে পরিত্যাগ করা যায় না বরং মাুনষের উচিত জিয়ারতে বিদয়াতের বিরোধিতা করা এবং সম্ভব হলে তা মুলোচ্ছেদ করা। আল্লামা ইবনে হাজর বলেন, উক্ত মতের সমর্থনে বলা যায় যে, জানাজার পেছনে কবর পর্যন্ত যাওয়া পরিত্যাগ করা যাবে না যদিও উহার সাথে ক্রন্দনকারিনী মহিলাগণ থাকে। (এ কথায় কোনো দ্বিমত নেই)। দুররে মুখতার ও রদ্দুল মুহতার ১/৮৪৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
কবর জিয়ারতের আদব
ফতহুল কাদীর গ্রন্থে লিখিত আছে যে, দাঁড়িয়ে জিয়ারত করা সুন্নাত জিয়ারত করার পর দাঁড়িয়ে দোয়া ও মোনাজাত করা সুন্নাত। কেননা, হযরত রাসূল আকরাম জান্নাতুল বাকীতে জিয়ারতকালে এরূপ করেছেন। আরো বলেছেন, আস্সালামু আলাইকুম দারা কাওমিম্ মুমিনীন। ওয়া ইন্না ইনশা আল্লাহু বিকুম লাহেকুন। মুল্লা আলী কারী শরহে লোবাবে লিখেছেন, ফোকহায়ে কেরাম আদবে জিয়ারত সম্পর্কে বলেছেন, মৃত ব্যক্তির পায়ের নিকটে জিয়ারতকারী দাঁড়াবে। মাথার নিকটে নয়, কেননা তাতে মৃত ব্যক্তির জিয়ারতকারীকে দেখতে কষ্ট হয়, পায়ের নিকট দাঁড়ালে মৃত ব্যক্তির চোখ বরাবর হয়। তবে এ পদ্ধতি তখনই আমল করা যাবে যখন পায়ের নিকট দাঁড়ানো সম্ভব হবে। যেহেতু হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূল করীম মৃত ব্যক্তির নিকট দাঁড়িয়ে সূরা বাকারা এবং পায়ের নিকট সূরায়ে বাকারার শেষ অংশ পড়েছেন। কবর জিয়ারতের আদবের মধ্যে ইহাও আছে, ছহীহ কাওল মতে, ...বলবে। যেহেতু হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, হুজুর পাক জিয়ারতে বলেছেন�
অতঃপর দাঁড়ানো অবস্থায় লম্বা দোয়া করবে। আর যদি বসে জিয়ারত করতে চায় তাহলে ঐ লোকের জীবদ্দশায় তার সম্মানে যতদূর নিকটে বা দূরে বসেছে ততটুকু দূরে বা নিকটে বসবে। সূরায়ে ইয়াসীন পড়তে তাতে আল্লাহপাক যত মৃত ব্যক্তি ঐ কবরস্থানে আছে তাদের সংখ্যানুপাতে নেকী দেবেন এবং তাদের আযাব হাল্কা করবেন। শরহে লুবাবে আছে জিয়ারতকারীর পক্ষে যা পাঠ করা সম্ভব যেমন, সূরায়ে ফাতিহা, বাকারা...মুফলেহুন পর্যন্ত, আয়াতুল কুরছি, আমানার রাসূলু, সূরা ইয়াসীন, সূরা মুলক, তাকাছুর, এখলাছ ১২ বার, ১১ বার, ৭ বার, ৩ বার পড়ে বলবে, হে খোদা আমি যা কিছু সূরা কিরাত পড়লাম উহার ছওয়াব এই মৃত ব্যক্তিদের নিকট পৌঁছে দিন। (শামী ১/৮৪৪ পৃষ্ঠা)।
মারাকিল ফালাহ গ্রন্থের ২৪২ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে, শরহুল মিশকাত গ্রন্থে আছে, জিয়ারতকারী কবরবাসীর জীবদ্দশায় তার সম্মানে যতটুকু নিকটে বা দূরে দাঁড়াত বা বসত তেমনিভাবে জিয়ারত করার সময়ও দাঁড়াবে বা বসবে। এরূপ অন্যান্য ফকীহগণও উল্লেখ করেছেন।
কুহেস্তানী গ্রন্থে লিখিত আছে যে, জিয়ারতকারী কবরবাসীর সম্মুখে এভাবে দাঁড়াবে যেরূপ জীবিত কালে সামনে দূরে বা নিকটে দাঁড়াত। এহইয়াউল উলুম কিতাবে লিখিত আছে, কবর জিয়ারত কালে মুস্তাহাব তরীকা হলো কিবলোকে পেছনে রেখে মাইয়্যেতের চেহারামুখী হয়ে দাঁড়াবে, সালাম দেবে। কবর স্পর্শ করবে না বা চুম্বন করবে না ও কবরকে মাসেহ করবে না এসব করা নাছারাদের অভ্যাস। অনুরূপ বর্ণনা শরহুশ শেরআত কিতাবে আছে। শরহুল মিশকাতে আছে যে, মুস্তাহাব তরীকা হলো, মৃতদের উপর সালাম দেয়ার সময় তাদের সম্মুখীন হয়ে সালাম প্রদান করা এবং ঐ অবস্থায় মাইয়্যেতের দিকে মুখ করে দোয়া করা। মুসলিম সমাজে এ তরীকাই প্রচলিত।
এবনে হাজর আসকলানী শাফেয়ী বলেছেন, এরূপ করা মুস্তাহাব নয়। ইজতেযকার ও তামহীদ কিতাবে ছহীহ সনদের সাথে এবনে আব্দুল বর হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন, হযরত রাসূল মকবুল বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে থাকে সে দুনিয়ায় তাকে চিনতো, এমতাবস্থায় সালাম করলে উক্ত মৃত ব্যক্তি সালামদাতাকে চিনে তার সালামের জবাব দিয়ে দেয়। (মারাকিল ফালাহ ৩৪২ পৃষ্ঠা)
কবর জিয়ারতের পবিত্র কুরআন পাঠ
করলে উহার ছওয়াব মৃত ব্যক্তি পায়
হেদায়া গ্রন্থের অধ্যায়ে ওলামায়ে হানাফিয়া অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, মানুষ নামাজ, রোজা ছদকা আরো অন্যান্য এবাদত করে উহার ছাওয়াব যদি অপরকে প্রদান করেন করতে পারেন। এতে কোনো আপত্তি নেই। মুহীত কিতাব হতে তাতার খানিয়া গ্রন্থে যাকাত অধ্যায়ে লিখিত আছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি নফল ছদ্কায় সারা পৃথিবীর মুসলিম নর-নারীর নিয়্যাত করে উহা উত্তম হয়, উক্ত ছওয়াব তাদের আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে। তাতে ছদ্কাদাতার ছওয়াব কম হবে না। ইহা আহলে সুন্নাতুল জামায়াতের অভিমত। তবে ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন যে, শুধু শারীরিক ইবাদত যথা নামাজ ও তিলাওয়াতে কুরআন= এর ছওয়াব মৃত ব্যক্তিকে প্রদান করলে উহা মৃতগণ পাবেন না। হ্যাঁ, নফল ছদকা ও হজ্বের ছওয়াব দান করলে উহা মৃত ব্যক্তিগণ পাবেন। মো�তাযিলা বাতিল ফেরকার অভিমত হলো যে, কোনো প্রকারের দান খয়রাতের ছওয়াব মৃতদের নিকট পৌঁছে না। এরূপ ফতহুল কাদীর গ্রন্থে বর্ণিত আছে।
আল্লামা শামী বলেন, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-এর যে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে, উহা সর্বজন বিদিত মত। তবে ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-এর পরবর্তী অনুসারীগণ যা ব্যক্ত করেছেন তা হলো মৃত ব্যক্তির নিকট দাঁড়িয়ে বা বসে সূরা কিরাত পাঠ করলে অথবা কিরাতের পর তার জন্য দোয়া করা হলে উহার ছওয়াব তার রূহে পৌঁছে। যদি সে দূরে তথা অদৃশ্য হয়। কেননা, তিলাওয়াতের স্থানে বরকত ও রহমত নাযিল হয় এবং কুরআন শরীফ তিলাওয়াত অন্তে দোয়া করলে উক্ত দোয়া কবুলের আশা বেশি। এতে ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন পাক তিলাওয়াত অন্তে তারা দোয়া করেন এভাবে যে, ওহে আল্লাহ! আমি যা কুরআন পাক হতে পড়লাম, উহার ন্যায় উপকার অমুক ব্যক্তিকে পৌঁছান। কিন্তু আমাদের আয়েম্মায়ে হানাফিয়াদের মতে, মৃত ব্যক্তির নিকট কুরআন পাঠের ছওয়াব পৌঁছে।
বাহরুর রায়েক কিতাবে আছে, কোনো ব্যক্তি যদি রোজা রাখে, নামাজ পড়ে অথবা ছদকা করে, আর উক্ত রোজা, নামাজ ও ছদকা খয়রাতের ছওয়াব মৃত ও জীবিত ব্যক্তিদেরকে দান করে উহা জায়েয এবং ঐ রোজা, নামাজ, ছদকার ছওয়াব মৃতদের আমলনামায় পৌঁছে যায়। এটাই আহলে সুন্নাতুল জামাতের মত। এরূপ বাদায়ে কিতাবে লিখিত আছে। শামী ১/৮৪৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য