জেনে রাখ:
মুরীদের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মগুলোর একটি হলো তার শায়খ তথা পীরের
প্রতি আদবশীলতা রক্ষার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া; কেননা, এই আচরণ-সচেতনতা
অন্তরে ভালবাসা সৃষ্টি করে। এটা বাস্তব যে তোমার আচার-ব্যবহারের সৌন্দর্যের
মাঝে তোমার আত্মার সৌন্দর্য ও তোমার মেধা বা বুদ্ধিবৃত্তির পূর্ণতা
দৃশ্যমান হয়। তুমি সর্বদা তোমার শায়খের প্রতি আদবশীল হলে তাঁর অন্তরে তোমার
প্রতি ভালবাসা পয়দা হবার ফলে সেখানে তোমার একটি স্থানও নির্দিষ্ট হবে; আর
এরই ফলশ্রুতিতে খোদা তা’লার করুণাও তোমার প্রতি বর্ষিত হবে। মহান আল্লাহ্
পাক তাঁর বন্ধু (ওলী)-দের অন্তরগুলোতে রহমত (করুণা) ও যত্নের দৃষ্টি রাখেন।
মুরীদ যদি পীরের অন্তরে স্থায়ী আসন করে নিতে পারে, তবে স্থায়ী খোদায়ী
করুণা ও আশীর্বাদ তারই প্রাপ্য হবে। তোমার শায়খ কর্তৃক তোমাকে কবুল করার
চিহ্ন হবে এই যে তোমার প্রতি তাঁর আর কোনো আপত্তি থাকবে না, যা আল্লাহ্,
তাঁর রাসূল (দ:) ও সকল পীর-মাশায়েখ যাঁরা তোমার শায়খ ও রাসূলুল্লাহ্
(দ:)-এর মধ্যকার সিলসিলাগত যোগসূত্র, তাঁদের কাছে তোমার কবুল হবার সুস্পষ্ট
প্রমাণ।
শুধু সুন্দর আদব-কায়দা ও আচরণ দ্বারাই তোমার পীরের প্রতি কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করা যায়। ধর্মীয় জ্ঞান বিশারদ তথা পীর মাশায়েখবৃন্দ যাঁরা তোমাদের রূহানী পিতা, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তোমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য সম্পন্ন করো; এতে অবহেলা চরম অবজ্ঞা ও অমান্য করার প্রবণতা ছাড়া আর কিছু নয়। একটি হাদীসে আমাদের মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান- “যে ব্যক্তি মরুব্বীদের সম্মান করে না এবং ছোটদের আদর করে না এবং উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীদের হক তথা অধিকার স্বীকার করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” তুমি যদি তোমার শায়খের অধিকারকে অবহেলা করো, যিনি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাঁর অধিকার দ্বারা আল্লাহ্ তা’লার অধিকারের প্রতিনিধিত্ব করেন, তবে তুমি খোদা তা’লার প্রতি কর্তব্য পালনেও ব্যর্থ হবে; কেননা, “তোমার মুরশিদের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করলে তুমি আল্লাহর কাছে পৌঁছুতে পারবে না।” একজন শায়খ তাঁর মুরীদানদের মধ্যে সেই রকম হেদায়াতকারী যেমনটি নবী (দ:) তাঁর উম্মতের মাঝে। যখন পীর সাহেব তোমাকে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পথ অনুসরণের আহ্বান জানান, তখন তিনি বিশ্বনবী (দ:)-এর প্রতিনিধি। যথা- এরশাদ হয়েছে:
”আশ্ শায়খু ফী কওমিহী কান্ নবীয়্যে ফী উম্মাতিহী”
অর্থাৎ, “একজন পীর তাঁর (অনুসারী সিলসিলাধারী) মুরীদানদের জন্যে সেই রকম হেদায়াতকারী, যেমনটি নবী (দ:) তাঁর উম্মতের মাঝে।”
আমার জ্ঞানে বর্তমানে মুরীদের জন্যে পনেরোটি আদব রয়েছে যা সে তার পীরের প্রতি পালন করবে। এ আদবগুলো একাধারে আম (সার্বিক) ও খাস্ (সুনির্দিষ্ট) উভয়ই।
প্রথম আদবটিতে এই বিশ্বাস ব্যক্ত হয়েছে যে তোমার জ্ঞান অর্জন, হেদায়েত (পথ প্রদর্শন), প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা-দীক্ষা সবই তোমার পীর দেখা শোনা করবেন। তুমি যদি কাউকে তাঁর সাথে তুলনীয় মনে করো বা ওই ব্যক্তিকে আরও পূর্ণতাপ্রাপ্ত মনে করো, তাহলে বোঝা যাবে তোমার শায়খের সাথে তোমার ভালবাসা ও টানের সম্পর্ক দুর্বল এবং এই কারণেই তোমার পীরের কথা ও তাঁর আধ্যাত্মিক হাল বা অবস্থাগুলো তোমার ওপর সামান্য প্রভাব ফেলবে। তাঁর কথা ও আদেশকে তোমার ওপর প্রভাব ফেলতে হলে এবং তাঁর হালতগুলোকে তোমার উপলদ্ধি করতে হলে যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হলো মুহব্বত (ভালবাসা)। তোমার ভালবাসা যতো বেশি পূর্ণতা পাবে ও গভীর হবে ততোই তাঁর শিক্ষাগুলো তোমার বোধগম্য হতে থাকবে।
দ্বিতীয় আদবটি হলো তোমার শায়খের আদেশ-নিষেধ মান্য করার বেলায় তোমার স্থির সিদ্ধান্ত ও অটল থাকা। তোমার এটা জানা উচিৎ যে, তাঁকে মানা ও তাঁর খেদমতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মাঝেই খোদায়ী করুণার দ্বার অবারিত হবে। ‘হয় আমি পীরের দোরগোড়ায় জান দেবো, নয়তো লক্ষ্যে পৌঁছাবো।’ এর লক্ষণ হলো, যখন পীর সাহেব তোমাকে কোনো বিষয়ে ‘না’ বলেন বা দূরে সরিয়ে দেন, তখন তুমি তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। কেননা, তোমার আধ্যাত্মিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে সময়ে সময়ে তিনি তোমাকে পরীক্ষা করবেন।
আবু উসমান হিরী (বেসাল ২৯৮ হিজরী/৯৬০-১১ খৃষ্টাব্দ; খোরাসানী সূফীদের নক্ষত্র) তাঁর পীর শাহ কেরমানী (বেসাল ৩০০ হিজর/৯১২-১৩ খৃষ্টাব্দ; আবু তোরাব নক্শাবীর মুরীদ)-এর আদেশ অনুসারে আবু হাফসে হাদ্দাদ (বেসাল ২৭০ হিজরী/৮৮৩-৪ খৃষ্টাব্দ বা তারও আগে; তিনি মালামাতিয়া তথা দায় বহনের তরীকার অনুসারী)-কে দেখতে নিশাপুরে আসেন। আবু হাফসে হাদ্দাদের ঐশী পরশময় চাহনি আবু উসমানকে এতোই আকর্ষণ করলো যে তিনি তাঁর জালে আটক হয়ে গেলেন। নিশাপুর থেকে ফেরার সময় হলে আবু উসমান তাঁর পীর শাহ কেরমানীর কাছে নিশাপুরে থাকার অনুমতি চান। এ সময় তিনি তাঁর পূর্ণ যৌবনে ছিলেন। আবু হাফস্ হাদ্দাদ অবশ্য তাঁকে দূরে সরিয়ে দিলেন এ কথা বলে, “আমার সোহবতে (সান্নিধ্যে) বসার কোনো অনুমতি তোমার নেই।” আবু উসমান এই সিদ্ধান্ত মেনে তাঁকে সামনে রেখে পেছনের দিকে হেঁটে বেরিয়ে এলেন যতোক্ষণ না শায়খ আবু হাফস্ দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন। অতঃপর আবু উসমান শায়খের দরজার বাইরে একটি গর্ত খুঁড়ে সেখানে বসে গেলেন এই নিয়্যতে যে আবু হাফস্ তাঁকে না গ্রহণ করা ও না ডাকা পর্যন্ত তিনি সেখান থেকে নড়বেন না। আবু হাফস্ তাঁর এ নিষ্ঠাপূর্ণ নিয়্যত দেখে তাঁকে কাছে ডাকলেন ও তাঁর বিশেষ সঙ্গীদের একজন হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করলেন; অতঃপর তাঁকে নিজ কন্যার সাথে বিয়ে দিলেন ও উত্তরাধিকারী হিসেবে খেলাফত দান করলেন। শায়খের বেসালের পরে আবু উসমান ত্রিশ বছর সাজ্জাদানশীন খলীফা ছিলেন।
তৃতীয় আদবটি হলো, তোমার শায়খের পছন্দ-অপছন্দের মাঝে নিজেকে তুমি সমর্পিত করবে। মুরীদ হিসেবে তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিংবা মালিকানাধীন সম্পদের ব্যাপারে তোমার পীরের প্রতিটি সিদ্ধান্ত তোমাকে মেনে চলতে হবে এবং এতে সমর্পিত ও সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এটাই একমাত্র পথ যা দ্বারা তুমি তাঁর অমূল্য মনোযোগ আকর্ষণ ও ভালবাসা অর্জন করতে সক্ষম হবে। তোমার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা পরিমাপের এটাই হলো মাপকাঠি - যেমনিভাবে আল্ কুরআনে বিবৃত হয়েছে- “অতএব, হে মাহবুব! আপনার প্রতিপালকের শপথ, তারা মুসলমান হবে না যতোক্ষণ পরস্পরের ঝগড়ার ক্ষেত্রে আপনাকে বিচারক না মানবে; অতঃপর যা কিছু আপনি নির্দেশ করবেন, তাদের অন্তরসমূহে সে সম্পর্কে কোনো দ্বিধা থাকবে না এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেবে” (সুরা নিসা, ৩৫ আয়াত)।
চতুর্থ আদব শর্তারোপ করে যে তুমি তোমার পীরের সমালোচনা করবে না। নিজ পীরের পছন্দ-অপছন্দ ও সিন্ধান্তগুলোর সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া মুরীদের উচিৎ নয়- তা অন্তরে হোক বা প্রকাশ্যেই হোক। তোমার পীরের কোনো কিছু অস্পষ্ট মনে হলে সর্বদা মূসা (আ:) ও খিযির (আ:)-এর ঘটনাটির কথা স্মরণ করবে (সূরা কাহাফ, ৬০-৮২ আয়াতসমূহ)। এতে বর্ণিত হয়েছে যে হযরত মূসা (আ:) আল্লাহর নবী ও মহাজ্ঞানী এবং খিযির (আ:)-এর প্রতি ভক্ত-অনুরক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কিছু কাজের সামলোচনা করেছিলেন; কিন্তু ওগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ জানার পর নিজ ধারণা পরিবর্তন করেছিলেন। তোমার শায়খের কোনো কাজ যদি তোমার বোধগম্য না হয়, তবে তোমার বলা উচিৎ যে তোমার উপলব্ধি ক্ষমতা ও জ্ঞান সীমাবদ্ধ; আর এটি কোনোক্রমেই তোমার পীরের ভুল-ত্রুটি বা ভ্রান্ত আচরণের ব্যাপার নয়। ফলে তোমার পীরের সাথে তোমার সম্পর্কে ফাটল ধরার সম্ভাবনা থেকে তুমি মুক্ত থাকবে এবং তাঁর মুহব্বতেও ঘাটতি পড়বে না। একবার হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ: - বেসাল ৯১০ খৃষ্টাব্দ)-কে জনৈক মুরীদ একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে এবং তাঁর উত্তর পাবার পরে এর সমালোচনা করে। হযরত জুনাইদ (রহ:) তখন কুরআন মজীদের একটি আয়াতে করীমা পড়ে শোনান:
”আর তোমরা যদি আমাকে বিশ্বাস না করো, তাহলে আমার কাছ থেকে সরে যাও” (সূরা দুখান, ২১ আয়াত)।
পঞ্চম আদবটি হলো, তুমি তোমার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ পরিহার করবে। পীর কী চান বা কী পছন্দ করেন তা না জেনে মুরীদের কোনো কাজই করার অনুমতি নেই- চাই সেই কাজ হোক ধর্মীয় বা বৈষয়িক, আম (সার্বিক) কিংবা খাস (সুনির্দিষ্ট)। তাঁর অনুমতি ছাড়া তুমি পানাহার করবে না, সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরবে না, উপহার দেবে না, ঘুমোবে না, কিছু নেবেও না, দেবেও না। তোমার শায়খের অনুমতি ও নির্দেশ ছাড়া কোনো ধর্মীয় কাজেও জড়াবে না। এক রাতে রাসূলে পাক (দ:) হযরত আবু বকর (রা:)-এর বাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন; এমতাবস্থায় তিনি হযরত আবু বকর (রা:)-কে রাতের নামাজে নিচু স্বরে কুরআন তেলাওয়াত করতে শুনতে পেলেন। অতঃপর তিনি হযরত উমর (রা:)-এর বাসার পাশ দিয়ে যাবার সময় তাঁকে রাতের নামাযে উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করতে শুনলেন। সকালে যখন উভয়েই রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দরবারে হাজির হলেন, তিনি হযরত আবু বকর (রা:)-কে জিজ্ঞেস করলেন কেন তিনি নিচু স্বরে কুরআন তেলাওয়াত করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা:) উত্তর দিলেন, “আমি যাঁর সাথে আলাপ করি তাঁর কথা শুনি।” হযরত ওমর (রা:)-কে তাঁর উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াতের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিন উত্তর দেন, “আমি শয়তানকে তাড়িয়ে দেই এবং যারা ঘুমোয় তাদেরও জাগিয়ে দেই।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (দ:) তাঁদের দু’জনকে উচ্চস্বর বা নিচু স্বর কোনোটিতেই তা করতে বারণ করলেন বরং মধ্যম রাস্তা অনুসরণ করতে বল্লেন। এমতাবস্থায় কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হলো- “এবং আপন নামায না খুব উচ্চস্বরে পড়ো, না একেবারে ক্ষীণ স্বরে এবং এই দুয়ের মধ্যবর্তী পথ সন্ধান করো” (সুরা বনী ইসরাইল, ১১০ আয়াত)। এতে প্রমাণিত হয় যে তোমার যদি আধ্যাত্মিক পীর তথা পথপ্রদর্শক থাকেন, তবে তোমার উচিৎ হবে না নিজের উপলব্ধি অনুযায়ী চলা। এটা আধ্যাত্মিক জগতের প্রকৃত উপলদ্ধির বেলায়ও প্রযোজ্য হবে।
যষ্ঠ আদবটি হলো, তোমার শায়খের চিন্তাধারাকে মেনে চলতে হবে। শায়খের চিন্তা-ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে, এমন কোনো কিছুতে মুরীদের ব্যাপৃত হওয়া উচিৎ নয়। তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা তোমার উচিৎ নয়। কেননা, তোমার শায়খের দয়া, সম্পূর্ণ ক্ষমা, বন্ধুত্ব ও ক্ষমাশীলতার ওপর তুমি নির্ভরশীল। শায়খের সচেতন মনে প্রত্যাখ্যান কিংবা গ্রহণের কারণে যা কিছু প্রবেশ করে তা মুরীদের সত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
সপ্তম আদব তোমার কাছে এটা দাবি করে যে তুমি স্বপ্নে যা দেখ তা তুমি তোমার পীরকে বলবে ও সেগুলোর ব্যাখ্যা চাইবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যার ব্যাপারে পীরের ওপর নির্ভর করবে; হতে পারে এসব স্বপ্ন জাগ্রত অবস্থায় কিংবা ঘুমে। এগুলোতে কোনো ক্ষতি নেই মর্মে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে না। এ সব স্বপ্ন হয়তো তোমার আত্মার গোপন আকাঙ্ক্ষা থেকেও সম্ভব হতে পারে এবং তুমি সেগুলোকে সেভাবে বিচার নাও করতে পারো ও ক্ষতিকর নাও মনে করতে পারো। এটা প্রকৃত চিত্র নাও হতে পারে। তবে তুমি যখন তোমার পীরকে এগুলো সম্পর্কে বলবে এবং তিনি তাঁর সুগভীর জ্ঞান দ্বারা এগুলোর সাথে পরিচিত হবেন, তখন বাস্তবিকভাবে এগুলো কখন ক্ষতিকর নয় তা বুঝতে তোমার পীরের মতামত তোমাকে সাহায্য করবে। এটা যখন আঘাতের ইঙ্গিত বহন করবে, তখন তাও বোঝা যাবে।
অষ্টম আদবটি তোমার কাছে এটা দাবি করে যে তুমি তোমার পীরের কথা কান দিয়ে শুনবে। শায়খের ঠোঁট থেকে যা বের হয়ে আসবে তা শোনার জন্যে মুরীদের উচিৎ অপেক্ষা করা ও তাতে মনোযোগী হওয়া। তার উচিৎ নিজ শায়খের জিহ্বাকে খোদা তা’লা ভাষণের অভিব্যক্তি মনে করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে তিনি নিজ আকাঙ্ক্ষা হতে কিছু বলেন না বরং যা বলেন তা “খোদা বান্দার মাধ্যমে কথা বলেন” এমন মাকামে উন্নীত হয়েই ব্যক্ত করেন। তোমার উচিৎ তাঁর হৃদয়কে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মণিমুক্তাসমৃদ্ধ একটি মহাসাগর মনে করা; যে মহাসাগর প্রাক-অনন্তকালের খোদায়ী ইচ্ছার বায়ুপ্রবাহে এ সব রত্নের কিছু কিছুকে পীরের সৈকতসম জিহ্বায় ভাসিয়ে নিয়ে আসে।
অতএব, তোমার উচিৎ এ ব্যাপারে যত্নবান ও মনোযোগী হওয়া যাতে করে তোমার জন্যে উপকারী হতে পারে পীরের এমন কথা শোনা থেকে তুমি বঞ্চিত না হও।
তোমার নিজের হাল তথা অবস্থার সাথে তোমার পীরের প্রতিটি কথাকে তুমি সমন্বয় সাধন করতে চেষ্টা করবে। এ কথা তুমি চিন্তা করবে যে খোদার দরবারে তোমার কল্যাণের জন্যে তুমি একটি দরখাস্ত পেশ করছো গ্রহণোম্মুখ জিহ্বা সহকারে; আর এই গ্রহণোম্মুখতার পরিপ্রেক্ষিতে গায়েব থেকে তোমার প্রতি একটি ভাষণ অবতীর্ণ হয়েছে। নিজ পীরের সাথে কথা বলার সময় তুমি নফসানীয়াত (একগুঁয়ে সত্তা) ত্যাগ করবে; নিজ জ্ঞান ও ঐশী অন্তর্দৃষ্টিকে সদ্ব্যবহার করে তোমার উচিৎ হবে কপটতা ত্যাগ করা এবং নিজেকে পূর্ণ ও সুন্দর হিসেবে পেশ করা। কেননা, যখন তুমি নিজেকে ব্যক্ত করতে চেষ্টা করবে ও কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে, তখনই তুমি নিজেকে মুরীদের অবস্থান থেকে সরিয়ে ফেলবে এবং শায়খের কথা শোনার ক্ষেত্রে নিজেকে বধির বানিয়ে ফেলবে। কুরআনের আয়াত-
’হে ঈমানদারবৃন্দ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর আগে বেড়ো না’ (সূরা হুজুরাত, ১ম আয়াত)। এ আয়াতের শানে নুযূল তথা প্রেক্ষাপট হিসেবে কিছু কিছু তফসীরকার লিখেছেন যে রাসূলে খোদা (দ:)-এর সাহচর্যে এমন কিছু মানুষ ছিলেন যারা হুজুর পাক (দ:)-কে কেউ কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর হিসেবে নিজেদের মতামত পেশ করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। এ আয়াত অবতীর্ণ হয়ে তা যে ভুল ও নিষিদ্ধ তা প্রমাণ করেছে।
নবম আদবটি শর্তারোপ করে যে তুমি তোমার কণ্ঠস্বর পীরের উপস্থিতিতে নিচু ও মোলায়েম রাখবে। তাঁর সান্নিধ্যে কখনো উচ্চস্বরে কথা বলবে না; কেননা এটা সৌজন্যের খেলাফ। এটা আপন মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার মতোই ব্যাপার। এ শিক্ষাটা দেয়ার জন্যেই কুরআনের আয়াত নাযেল হয়েছে- “হে ঈমানদারবৃন্দ! নিজেদের কণ্ঠস্বরকে ওই অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী)-র কণ্ঠস্বরের চেয়ে উঁচু করো না” (সূরা হুজুরাত, ২য় আয়াত)। অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁদের কণ্ঠস্বর এতোই নিচু করেন যে তাঁদের কথাবার্তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় কুরআনের আয়াত নাযেল হয়- “নিশ্চয় ওই সমস্ত মানুষ যারা আপন কণ্ঠস্বরকে আল্লাহর রাসূলের দরবারে নিচু রাখে, তাদেরকে আল্লাহ পাক তাদের খোদাভীরুতার বেলায় পরীক্ষা করে নিয়েছেন; তাদের জন্যে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার রয়েছে” (সূরা হুজুরাত, ৩য় আয়াত)।
দশম আদবটি তোমাকে তোমার আচরণে অবহেলা প্রদর্শন করতে বারণ করে। তোমার শায়খের সাথে কথায় বা কাজে খুব ফ্রি বা খোলামেলা আচরণ অনুমতিপ্রাপ্ত নয়; কেননা তাতে বিনয়ীভাব তিরোহিত হবে এবং যথাযথ আচরণও দূর হয়ে যাবে এবং এরই ফলশ্রুতিতে করুণা প্রবাহও বিঘ্নিত হবে। তোমার উচিৎ হবে তাঁকে সম্মানসহ সম্বোধন করা, যেমন- ইয়া শায়খী (হে আমার পীর) ইত্যাদি।
মহানবী (দ:)-এর সাহাবায়ে কেরাম প্রথম দিকে তাঁকে সম্বোধনের সময় সম্মানসহ তা করতেন না। তাঁরা বলেতন ‘মোহাম্মদ’ কিংবা ‘আহমদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। এমতাবস্থায় এটা নিষেধ করে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়: “রাসূল (দ:)-কে সম্বোধন করার সময় সেভাবে চিৎকার করো না যেভাবে একে অপরের প্রতি করে থাকো, যাতে তোমাদের আমলসমূহ বরবাদ না হয়ে যায়” (সূরা হুজুরাত, ২ নং আয়াত)। অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্’ (হে আল্লাহর রাসূল) বলে সম্বোধন করতেন। বানু তামীম গোত্রের কতিপয় প্রতিনিধি একবার মহানবী (দ:)-এর ঘরের সামনে গিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে বলে, “হে মোহাম্মদ! আামদের কাছে বেরিয়ে আসুন!” এতে কুরআনের আয়াত নাযেল হয়- “নিশ্চয় ওই সব লোক যারা আপনাকে হুজরাসমূহের (প্রকোষ্ঠ) বাইরে থেকে আহ্বান করে তাদের মধ্যে অধিকাংশই নির্বোধ এবং যদি তারা ধৈর্য ধারণ করতো আপনি তাদের কাছে বের হওয়া পর্যন্ত, তবে তা তাদের জন্যে ভাল হতো।” (সূরা হুজুরাত, ৪-৫ আয়াত)। তোমার পীরের সাথে কথাবর্তা বলার সময় যেমন তুমি খোলামেলা হবে না, তেমনি কাজে কর্মেও তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাকে তোমার কর্তব্য মনে করবে। তাই পীরের দরবারে তোমার জায়নামাজ শুধু নামাযের সময় হলেই বিছিয়ে দেবে। তাঁর সামনে সূফীবৃন্দের সেমা (কাওয়ালী/মরমী সংগীত) শোনার সময় যতোক্ষণ তোমার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে, ততোক্ষণ চিৎকার বা ওয়াজদ (দৈনিক স্পন্দন) করবে না। হাসাহাসিও করবে না।
এগারোতম আদব তোমার প্রতি শর্তারোপ করে যে, কথা বলার সঠিক সময়টুকু তোমার জানা প্রয়োজন। মুরীদ যখন ধর্মীয় বা বৈষয়িক গুরুত্বপূণ বিষয় সম্পর্কে আলাপ করতে চায়, তখন তার উচিৎ এটা দেখে নেয়া যে তার পীর এ ব্যাপার তার মূল্যবান সময় দিতে রাজি আছেন কিনা; অর্থাৎ, তিনি মুরীদের কথা শুনতে ইচ্ছুক কিনা। তোমার শায়খের সাথে কথা বলার সময় তোমার তাড়াহুড়ো করা উচিৎ নয়। আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা কামনা করো যাতে করে আদব পালনের ক্ষেত্রে কোনো ভুল-ত্রুটি না হয়ে যায়, কোনো বেয়াদবী না হয়ে যায়। এ সময় খোদা তা’লার এতো নিকটবর্তী হওয়ার কারণে পীরের দরবারে হাদিয়া পেশ করা যথোচিৎ হবে। মহানবী (দ:)-এর দরবারেও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর কাছে কিছু আরয করার আগে এ রকম হাদিয়া পেশ করতেন, যেমনিভাবে কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছে; “হে ঈমানদারবৃন্দ! তোমরা যখন রাসূল (দ:)-এর কাছে কোনো কথা গোপনে আরয করতে চাও, তবে তা করার আগে কিছু সাদকাহ্ (হাদিয়া) পেশ করো (রাসূলের কাছে)” (সূরা মুজাদালা, ১২ আয়াত)।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরকার শিরোমণি হযরত ইবনে আব্বাস (রা: বেসাল- ৬৮৭/৯০ খৃষ্টাব্দ) বলেন: “এ আয়াতটি অবতীর্ণ হবার কারণ হলো মানুষেরা হুজুর পূর নূর (দ:)-এর দরবারে হাজির হয়ে মাত্রাতিরিক্ত পীড়াপীড়িমূলক প্রশ্ন করতো এবং তাঁকে পেরেশান করতো।”
বারোতম আদব দাবি করে যে তুমি তোমার আধ্যাত্মিক মকামের সীমানাগুলো পাহারা দেবে। পীরকে প্রশ্ন করার সময় মুরীদের উচিৎ নিজ মকামের সীমা বজায় রাখা। শুধু তোমার আধ্যাত্মিক অবস্থা-সম্পর্কিত তোমার কাছ থেকে গোপন বা আড়াল যে কোনো বিষয় সম্পর্কেই তুমি তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারবে। অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করো না; এটা তোমার মকাম বা হালের সাথে সম্পর্কিত এমন বিষয়গুলোর বেলায়ও প্রযোজ্য। অতএব, এগুলো সম্পর্কে পীরের সাথে আলাপ করো না; কেননা এগুলো উপকারী নয়, এমন কি ক্ষতিকরও হতে পারে। তোমার আধ্যাত্মিক অবস্থার সাথে যা কিছু জড়িত শুধু সে সম্পর্কেই প্রশ্ন করবে। এ ধরনের বাহুল্য প্রশ্নের ব্যাপারে কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে- “হে ঈমানদারবৃন্দ! তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যেগুলো তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হলে তোমাদের খারাপ লাগবে” (সূরা মাঈদাহ, ১০১ আয়াত)। উপকারী কথা হলো তা-ই যা শ্রোতার উপলব্ধি ক্ষমতার অনুকূল। আর উপকারী প্রশ্ন হলো তা-ই যা উত্তর শ্রবণকারীর মকামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তেরোতম আদব হলো তুমি তোমার পীরের গোপন রহস্য সম্পর্কে চুপ থাকবে। অলৌকিক ক্ষমতা, স্বপ্ন ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক বিষয় যা তোমার পীর গোপন রেখেছেন, তা প্রকাশ করার জন্যে তুমি অনুমতি চাইবে না। কেননা, এগুলো গোপন রাখার মাঝে তোমার পীর কোনো ধর্মীয় কিংবা দুনিয়াবী কল্যাণ দেখতে পেয়েছেন যা সম্পর্কে তুমি অবগত নও। এগুলো প্রকাশ করলে ক্ষতি হতে পারে।
এ আদবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মুরীদের সেই সব গোপন বিষয় যা পীরের জানা এবং যা পীরের কাছে গোপন রয়েছে। নিচের পংক্তিগুলো তাঁর হাল বর্ণনা করে:
’অনেক আন্তরিক ও মহৎ মানুষ আমার জানা,
যাদের গোপন বিষয় আমি অন্যদের থেকে করেছি আড়াল,
এসব যবে আমি রেখেছি আমা মাঝে লুকিয়ে,
প্রতিটি অন্তরেই রয়েছে মুক্ত একটি আঙ্গিনা,
যা এমনই রাজ্য যেখানে করা যায় ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা,
কাঙ্ক্ষিত নয় যার প্রকাশ ও প্রচারণা’।
চৌদ্দতম আদবের শর্ত এই যে, তুমি তোমার গোপন বিষয়গুলো তোমার পীরের কাছে প্রকাশ করবে। তা গোপন রাখার কোনো অনুমতি নেই। খোদা তা’লার তরফ থেকে তোমার প্রতি যে পুরস্কার বর্ষিত হয়েছে তার সবই পরিষ্কার ভাষায় ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সহকারে পীরের কাছে ব্যক্ত করবে, যাতে করে তিনি এগুলো সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, তোমার সজ্ঞানে কোনো ব্যক্তিগত গোপন বিষয় তাঁর কাছে গোপন রাখা হলো; এটি হয়তো পরবর্তী পর্যায়ে অন্তরে জট সৃষ্টি করতে পারে যার দরুণ হয়তো তোমার শায়খের কাছ থেকে উপদেশ ও সাহায্যপ্রাপ্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। তুমি এটা শায়খের খেদমতে পেশ করলে জট অপসারিত হবে।
পনেরোতম আদব দাবি করে যে তোমার পীর (কিংবা তাঁর কাছ থেকে তোমার কাছে আগত কিছু) সম্পর্কে অন্য কাউকে কিছু বলতে হলে তার উপলব্ধি ক্ষমতার সাথে বিষয়টি সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। এমন কোনো অস্পষ্ট কিংবা সূক্ষ্ম বিষয় তাকে বলো না যা সে বুঝতে অক্ষম। এটা তার জন্যে অর্থহীন, এমন কি ক্ষতিকরও হতে পারে। ওই ব্যক্তি হয়তো তোমার পীরের প্রতি বদ ধারণাও পোষণ করতে পারে।
মুরীদ এসব আদব পালন করলে খোদায়ী করুণার নূর (জ্যোতি/আলো) এবং তাঁর অফুরন্ত নেয়ামত (আশীর্বাদ) তোমার প্রতি অবতীর্ণ হবে; যার প্রতি তোমার লক্ষ্য ছিল তা তোমার যাহেরী (প্রকাশ্য) ও বাতেনী (অপ্রকাশ্য) সত্তায় প্রকাশ পাবে এবং তুমি খাস্ (বিশেষ) দলে নিজ স্থান করে নেবে। লক্ষ্য করো যে, ওপরে উদ্ধৃত ১৫টি আদব কেবলমাত্র যথাযথ আচরণ উপলব্ধি করার জন্যেই, যাতে করে শিক্ষা দান ও তা গ্রহণ সংঘটিত হতে পারে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে প্রতিটি সূফী তরীকা ও পীর মাশায়েখবৃন্দ এ সব আদবের সংস্কার সাধন করতে পারেন।
[মাহমুদ কাশানীর রচিত ‘মিসবাহ্ আল হেদায়া ওয়া মিফতাহ্ আল কেফায়া’ - “সঠিক পথের চেরাগ ও পর্যাপ্ত জ্ঞানের চাবিকাঠি” শীর্ষক পুস্তকের ১৫টি আদব অনুবাদ এখানে সমাপ্ত হলো)।
[এটি www.zahuri.org/article8.html শীর্ষক ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে]
শুধু সুন্দর আদব-কায়দা ও আচরণ দ্বারাই তোমার পীরের প্রতি কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করা যায়। ধর্মীয় জ্ঞান বিশারদ তথা পীর মাশায়েখবৃন্দ যাঁরা তোমাদের রূহানী পিতা, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তোমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য সম্পন্ন করো; এতে অবহেলা চরম অবজ্ঞা ও অমান্য করার প্রবণতা ছাড়া আর কিছু নয়। একটি হাদীসে আমাদের মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান- “যে ব্যক্তি মরুব্বীদের সম্মান করে না এবং ছোটদের আদর করে না এবং উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীদের হক তথা অধিকার স্বীকার করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” তুমি যদি তোমার শায়খের অধিকারকে অবহেলা করো, যিনি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাঁর অধিকার দ্বারা আল্লাহ্ তা’লার অধিকারের প্রতিনিধিত্ব করেন, তবে তুমি খোদা তা’লার প্রতি কর্তব্য পালনেও ব্যর্থ হবে; কেননা, “তোমার মুরশিদের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করলে তুমি আল্লাহর কাছে পৌঁছুতে পারবে না।” একজন শায়খ তাঁর মুরীদানদের মধ্যে সেই রকম হেদায়াতকারী যেমনটি নবী (দ:) তাঁর উম্মতের মাঝে। যখন পীর সাহেব তোমাকে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পথ অনুসরণের আহ্বান জানান, তখন তিনি বিশ্বনবী (দ:)-এর প্রতিনিধি। যথা- এরশাদ হয়েছে:
”আশ্ শায়খু ফী কওমিহী কান্ নবীয়্যে ফী উম্মাতিহী”
অর্থাৎ, “একজন পীর তাঁর (অনুসারী সিলসিলাধারী) মুরীদানদের জন্যে সেই রকম হেদায়াতকারী, যেমনটি নবী (দ:) তাঁর উম্মতের মাঝে।”
আমার জ্ঞানে বর্তমানে মুরীদের জন্যে পনেরোটি আদব রয়েছে যা সে তার পীরের প্রতি পালন করবে। এ আদবগুলো একাধারে আম (সার্বিক) ও খাস্ (সুনির্দিষ্ট) উভয়ই।
প্রথম আদবটিতে এই বিশ্বাস ব্যক্ত হয়েছে যে তোমার জ্ঞান অর্জন, হেদায়েত (পথ প্রদর্শন), প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা-দীক্ষা সবই তোমার পীর দেখা শোনা করবেন। তুমি যদি কাউকে তাঁর সাথে তুলনীয় মনে করো বা ওই ব্যক্তিকে আরও পূর্ণতাপ্রাপ্ত মনে করো, তাহলে বোঝা যাবে তোমার শায়খের সাথে তোমার ভালবাসা ও টানের সম্পর্ক দুর্বল এবং এই কারণেই তোমার পীরের কথা ও তাঁর আধ্যাত্মিক হাল বা অবস্থাগুলো তোমার ওপর সামান্য প্রভাব ফেলবে। তাঁর কথা ও আদেশকে তোমার ওপর প্রভাব ফেলতে হলে এবং তাঁর হালতগুলোকে তোমার উপলদ্ধি করতে হলে যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হলো মুহব্বত (ভালবাসা)। তোমার ভালবাসা যতো বেশি পূর্ণতা পাবে ও গভীর হবে ততোই তাঁর শিক্ষাগুলো তোমার বোধগম্য হতে থাকবে।
দ্বিতীয় আদবটি হলো তোমার শায়খের আদেশ-নিষেধ মান্য করার বেলায় তোমার স্থির সিদ্ধান্ত ও অটল থাকা। তোমার এটা জানা উচিৎ যে, তাঁকে মানা ও তাঁর খেদমতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মাঝেই খোদায়ী করুণার দ্বার অবারিত হবে। ‘হয় আমি পীরের দোরগোড়ায় জান দেবো, নয়তো লক্ষ্যে পৌঁছাবো।’ এর লক্ষণ হলো, যখন পীর সাহেব তোমাকে কোনো বিষয়ে ‘না’ বলেন বা দূরে সরিয়ে দেন, তখন তুমি তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। কেননা, তোমার আধ্যাত্মিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে সময়ে সময়ে তিনি তোমাকে পরীক্ষা করবেন।
আবু উসমান হিরী (বেসাল ২৯৮ হিজরী/৯৬০-১১ খৃষ্টাব্দ; খোরাসানী সূফীদের নক্ষত্র) তাঁর পীর শাহ কেরমানী (বেসাল ৩০০ হিজর/৯১২-১৩ খৃষ্টাব্দ; আবু তোরাব নক্শাবীর মুরীদ)-এর আদেশ অনুসারে আবু হাফসে হাদ্দাদ (বেসাল ২৭০ হিজরী/৮৮৩-৪ খৃষ্টাব্দ বা তারও আগে; তিনি মালামাতিয়া তথা দায় বহনের তরীকার অনুসারী)-কে দেখতে নিশাপুরে আসেন। আবু হাফসে হাদ্দাদের ঐশী পরশময় চাহনি আবু উসমানকে এতোই আকর্ষণ করলো যে তিনি তাঁর জালে আটক হয়ে গেলেন। নিশাপুর থেকে ফেরার সময় হলে আবু উসমান তাঁর পীর শাহ কেরমানীর কাছে নিশাপুরে থাকার অনুমতি চান। এ সময় তিনি তাঁর পূর্ণ যৌবনে ছিলেন। আবু হাফস্ হাদ্দাদ অবশ্য তাঁকে দূরে সরিয়ে দিলেন এ কথা বলে, “আমার সোহবতে (সান্নিধ্যে) বসার কোনো অনুমতি তোমার নেই।” আবু উসমান এই সিদ্ধান্ত মেনে তাঁকে সামনে রেখে পেছনের দিকে হেঁটে বেরিয়ে এলেন যতোক্ষণ না শায়খ আবু হাফস্ দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন। অতঃপর আবু উসমান শায়খের দরজার বাইরে একটি গর্ত খুঁড়ে সেখানে বসে গেলেন এই নিয়্যতে যে আবু হাফস্ তাঁকে না গ্রহণ করা ও না ডাকা পর্যন্ত তিনি সেখান থেকে নড়বেন না। আবু হাফস্ তাঁর এ নিষ্ঠাপূর্ণ নিয়্যত দেখে তাঁকে কাছে ডাকলেন ও তাঁর বিশেষ সঙ্গীদের একজন হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করলেন; অতঃপর তাঁকে নিজ কন্যার সাথে বিয়ে দিলেন ও উত্তরাধিকারী হিসেবে খেলাফত দান করলেন। শায়খের বেসালের পরে আবু উসমান ত্রিশ বছর সাজ্জাদানশীন খলীফা ছিলেন।
তৃতীয় আদবটি হলো, তোমার শায়খের পছন্দ-অপছন্দের মাঝে নিজেকে তুমি সমর্পিত করবে। মুরীদ হিসেবে তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিংবা মালিকানাধীন সম্পদের ব্যাপারে তোমার পীরের প্রতিটি সিদ্ধান্ত তোমাকে মেনে চলতে হবে এবং এতে সমর্পিত ও সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এটাই একমাত্র পথ যা দ্বারা তুমি তাঁর অমূল্য মনোযোগ আকর্ষণ ও ভালবাসা অর্জন করতে সক্ষম হবে। তোমার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা পরিমাপের এটাই হলো মাপকাঠি - যেমনিভাবে আল্ কুরআনে বিবৃত হয়েছে- “অতএব, হে মাহবুব! আপনার প্রতিপালকের শপথ, তারা মুসলমান হবে না যতোক্ষণ পরস্পরের ঝগড়ার ক্ষেত্রে আপনাকে বিচারক না মানবে; অতঃপর যা কিছু আপনি নির্দেশ করবেন, তাদের অন্তরসমূহে সে সম্পর্কে কোনো দ্বিধা থাকবে না এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেবে” (সুরা নিসা, ৩৫ আয়াত)।
চতুর্থ আদব শর্তারোপ করে যে তুমি তোমার পীরের সমালোচনা করবে না। নিজ পীরের পছন্দ-অপছন্দ ও সিন্ধান্তগুলোর সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া মুরীদের উচিৎ নয়- তা অন্তরে হোক বা প্রকাশ্যেই হোক। তোমার পীরের কোনো কিছু অস্পষ্ট মনে হলে সর্বদা মূসা (আ:) ও খিযির (আ:)-এর ঘটনাটির কথা স্মরণ করবে (সূরা কাহাফ, ৬০-৮২ আয়াতসমূহ)। এতে বর্ণিত হয়েছে যে হযরত মূসা (আ:) আল্লাহর নবী ও মহাজ্ঞানী এবং খিযির (আ:)-এর প্রতি ভক্ত-অনুরক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কিছু কাজের সামলোচনা করেছিলেন; কিন্তু ওগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ জানার পর নিজ ধারণা পরিবর্তন করেছিলেন। তোমার শায়খের কোনো কাজ যদি তোমার বোধগম্য না হয়, তবে তোমার বলা উচিৎ যে তোমার উপলব্ধি ক্ষমতা ও জ্ঞান সীমাবদ্ধ; আর এটি কোনোক্রমেই তোমার পীরের ভুল-ত্রুটি বা ভ্রান্ত আচরণের ব্যাপার নয়। ফলে তোমার পীরের সাথে তোমার সম্পর্কে ফাটল ধরার সম্ভাবনা থেকে তুমি মুক্ত থাকবে এবং তাঁর মুহব্বতেও ঘাটতি পড়বে না। একবার হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ: - বেসাল ৯১০ খৃষ্টাব্দ)-কে জনৈক মুরীদ একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে এবং তাঁর উত্তর পাবার পরে এর সমালোচনা করে। হযরত জুনাইদ (রহ:) তখন কুরআন মজীদের একটি আয়াতে করীমা পড়ে শোনান:
”আর তোমরা যদি আমাকে বিশ্বাস না করো, তাহলে আমার কাছ থেকে সরে যাও” (সূরা দুখান, ২১ আয়াত)।
পঞ্চম আদবটি হলো, তুমি তোমার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ পরিহার করবে। পীর কী চান বা কী পছন্দ করেন তা না জেনে মুরীদের কোনো কাজই করার অনুমতি নেই- চাই সেই কাজ হোক ধর্মীয় বা বৈষয়িক, আম (সার্বিক) কিংবা খাস (সুনির্দিষ্ট)। তাঁর অনুমতি ছাড়া তুমি পানাহার করবে না, সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরবে না, উপহার দেবে না, ঘুমোবে না, কিছু নেবেও না, দেবেও না। তোমার শায়খের অনুমতি ও নির্দেশ ছাড়া কোনো ধর্মীয় কাজেও জড়াবে না। এক রাতে রাসূলে পাক (দ:) হযরত আবু বকর (রা:)-এর বাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন; এমতাবস্থায় তিনি হযরত আবু বকর (রা:)-কে রাতের নামাজে নিচু স্বরে কুরআন তেলাওয়াত করতে শুনতে পেলেন। অতঃপর তিনি হযরত উমর (রা:)-এর বাসার পাশ দিয়ে যাবার সময় তাঁকে রাতের নামাযে উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করতে শুনলেন। সকালে যখন উভয়েই রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দরবারে হাজির হলেন, তিনি হযরত আবু বকর (রা:)-কে জিজ্ঞেস করলেন কেন তিনি নিচু স্বরে কুরআন তেলাওয়াত করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা:) উত্তর দিলেন, “আমি যাঁর সাথে আলাপ করি তাঁর কথা শুনি।” হযরত ওমর (রা:)-কে তাঁর উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াতের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিন উত্তর দেন, “আমি শয়তানকে তাড়িয়ে দেই এবং যারা ঘুমোয় তাদেরও জাগিয়ে দেই।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (দ:) তাঁদের দু’জনকে উচ্চস্বর বা নিচু স্বর কোনোটিতেই তা করতে বারণ করলেন বরং মধ্যম রাস্তা অনুসরণ করতে বল্লেন। এমতাবস্থায় কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হলো- “এবং আপন নামায না খুব উচ্চস্বরে পড়ো, না একেবারে ক্ষীণ স্বরে এবং এই দুয়ের মধ্যবর্তী পথ সন্ধান করো” (সুরা বনী ইসরাইল, ১১০ আয়াত)। এতে প্রমাণিত হয় যে তোমার যদি আধ্যাত্মিক পীর তথা পথপ্রদর্শক থাকেন, তবে তোমার উচিৎ হবে না নিজের উপলব্ধি অনুযায়ী চলা। এটা আধ্যাত্মিক জগতের প্রকৃত উপলদ্ধির বেলায়ও প্রযোজ্য হবে।
যষ্ঠ আদবটি হলো, তোমার শায়খের চিন্তাধারাকে মেনে চলতে হবে। শায়খের চিন্তা-ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে, এমন কোনো কিছুতে মুরীদের ব্যাপৃত হওয়া উচিৎ নয়। তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা তোমার উচিৎ নয়। কেননা, তোমার শায়খের দয়া, সম্পূর্ণ ক্ষমা, বন্ধুত্ব ও ক্ষমাশীলতার ওপর তুমি নির্ভরশীল। শায়খের সচেতন মনে প্রত্যাখ্যান কিংবা গ্রহণের কারণে যা কিছু প্রবেশ করে তা মুরীদের সত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
সপ্তম আদব তোমার কাছে এটা দাবি করে যে তুমি স্বপ্নে যা দেখ তা তুমি তোমার পীরকে বলবে ও সেগুলোর ব্যাখ্যা চাইবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যার ব্যাপারে পীরের ওপর নির্ভর করবে; হতে পারে এসব স্বপ্ন জাগ্রত অবস্থায় কিংবা ঘুমে। এগুলোতে কোনো ক্ষতি নেই মর্মে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে না। এ সব স্বপ্ন হয়তো তোমার আত্মার গোপন আকাঙ্ক্ষা থেকেও সম্ভব হতে পারে এবং তুমি সেগুলোকে সেভাবে বিচার নাও করতে পারো ও ক্ষতিকর নাও মনে করতে পারো। এটা প্রকৃত চিত্র নাও হতে পারে। তবে তুমি যখন তোমার পীরকে এগুলো সম্পর্কে বলবে এবং তিনি তাঁর সুগভীর জ্ঞান দ্বারা এগুলোর সাথে পরিচিত হবেন, তখন বাস্তবিকভাবে এগুলো কখন ক্ষতিকর নয় তা বুঝতে তোমার পীরের মতামত তোমাকে সাহায্য করবে। এটা যখন আঘাতের ইঙ্গিত বহন করবে, তখন তাও বোঝা যাবে।
অষ্টম আদবটি তোমার কাছে এটা দাবি করে যে তুমি তোমার পীরের কথা কান দিয়ে শুনবে। শায়খের ঠোঁট থেকে যা বের হয়ে আসবে তা শোনার জন্যে মুরীদের উচিৎ অপেক্ষা করা ও তাতে মনোযোগী হওয়া। তার উচিৎ নিজ শায়খের জিহ্বাকে খোদা তা’লা ভাষণের অভিব্যক্তি মনে করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে তিনি নিজ আকাঙ্ক্ষা হতে কিছু বলেন না বরং যা বলেন তা “খোদা বান্দার মাধ্যমে কথা বলেন” এমন মাকামে উন্নীত হয়েই ব্যক্ত করেন। তোমার উচিৎ তাঁর হৃদয়কে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মণিমুক্তাসমৃদ্ধ একটি মহাসাগর মনে করা; যে মহাসাগর প্রাক-অনন্তকালের খোদায়ী ইচ্ছার বায়ুপ্রবাহে এ সব রত্নের কিছু কিছুকে পীরের সৈকতসম জিহ্বায় ভাসিয়ে নিয়ে আসে।
অতএব, তোমার উচিৎ এ ব্যাপারে যত্নবান ও মনোযোগী হওয়া যাতে করে তোমার জন্যে উপকারী হতে পারে পীরের এমন কথা শোনা থেকে তুমি বঞ্চিত না হও।
তোমার নিজের হাল তথা অবস্থার সাথে তোমার পীরের প্রতিটি কথাকে তুমি সমন্বয় সাধন করতে চেষ্টা করবে। এ কথা তুমি চিন্তা করবে যে খোদার দরবারে তোমার কল্যাণের জন্যে তুমি একটি দরখাস্ত পেশ করছো গ্রহণোম্মুখ জিহ্বা সহকারে; আর এই গ্রহণোম্মুখতার পরিপ্রেক্ষিতে গায়েব থেকে তোমার প্রতি একটি ভাষণ অবতীর্ণ হয়েছে। নিজ পীরের সাথে কথা বলার সময় তুমি নফসানীয়াত (একগুঁয়ে সত্তা) ত্যাগ করবে; নিজ জ্ঞান ও ঐশী অন্তর্দৃষ্টিকে সদ্ব্যবহার করে তোমার উচিৎ হবে কপটতা ত্যাগ করা এবং নিজেকে পূর্ণ ও সুন্দর হিসেবে পেশ করা। কেননা, যখন তুমি নিজেকে ব্যক্ত করতে চেষ্টা করবে ও কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে, তখনই তুমি নিজেকে মুরীদের অবস্থান থেকে সরিয়ে ফেলবে এবং শায়খের কথা শোনার ক্ষেত্রে নিজেকে বধির বানিয়ে ফেলবে। কুরআনের আয়াত-
’হে ঈমানদারবৃন্দ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর আগে বেড়ো না’ (সূরা হুজুরাত, ১ম আয়াত)। এ আয়াতের শানে নুযূল তথা প্রেক্ষাপট হিসেবে কিছু কিছু তফসীরকার লিখেছেন যে রাসূলে খোদা (দ:)-এর সাহচর্যে এমন কিছু মানুষ ছিলেন যারা হুজুর পাক (দ:)-কে কেউ কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর হিসেবে নিজেদের মতামত পেশ করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। এ আয়াত অবতীর্ণ হয়ে তা যে ভুল ও নিষিদ্ধ তা প্রমাণ করেছে।
নবম আদবটি শর্তারোপ করে যে তুমি তোমার কণ্ঠস্বর পীরের উপস্থিতিতে নিচু ও মোলায়েম রাখবে। তাঁর সান্নিধ্যে কখনো উচ্চস্বরে কথা বলবে না; কেননা এটা সৌজন্যের খেলাফ। এটা আপন মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার মতোই ব্যাপার। এ শিক্ষাটা দেয়ার জন্যেই কুরআনের আয়াত নাযেল হয়েছে- “হে ঈমানদারবৃন্দ! নিজেদের কণ্ঠস্বরকে ওই অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী)-র কণ্ঠস্বরের চেয়ে উঁচু করো না” (সূরা হুজুরাত, ২য় আয়াত)। অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁদের কণ্ঠস্বর এতোই নিচু করেন যে তাঁদের কথাবার্তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় কুরআনের আয়াত নাযেল হয়- “নিশ্চয় ওই সমস্ত মানুষ যারা আপন কণ্ঠস্বরকে আল্লাহর রাসূলের দরবারে নিচু রাখে, তাদেরকে আল্লাহ পাক তাদের খোদাভীরুতার বেলায় পরীক্ষা করে নিয়েছেন; তাদের জন্যে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার রয়েছে” (সূরা হুজুরাত, ৩য় আয়াত)।
দশম আদবটি তোমাকে তোমার আচরণে অবহেলা প্রদর্শন করতে বারণ করে। তোমার শায়খের সাথে কথায় বা কাজে খুব ফ্রি বা খোলামেলা আচরণ অনুমতিপ্রাপ্ত নয়; কেননা তাতে বিনয়ীভাব তিরোহিত হবে এবং যথাযথ আচরণও দূর হয়ে যাবে এবং এরই ফলশ্রুতিতে করুণা প্রবাহও বিঘ্নিত হবে। তোমার উচিৎ হবে তাঁকে সম্মানসহ সম্বোধন করা, যেমন- ইয়া শায়খী (হে আমার পীর) ইত্যাদি।
মহানবী (দ:)-এর সাহাবায়ে কেরাম প্রথম দিকে তাঁকে সম্বোধনের সময় সম্মানসহ তা করতেন না। তাঁরা বলেতন ‘মোহাম্মদ’ কিংবা ‘আহমদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। এমতাবস্থায় এটা নিষেধ করে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়: “রাসূল (দ:)-কে সম্বোধন করার সময় সেভাবে চিৎকার করো না যেভাবে একে অপরের প্রতি করে থাকো, যাতে তোমাদের আমলসমূহ বরবাদ না হয়ে যায়” (সূরা হুজুরাত, ২ নং আয়াত)। অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্’ (হে আল্লাহর রাসূল) বলে সম্বোধন করতেন। বানু তামীম গোত্রের কতিপয় প্রতিনিধি একবার মহানবী (দ:)-এর ঘরের সামনে গিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে বলে, “হে মোহাম্মদ! আামদের কাছে বেরিয়ে আসুন!” এতে কুরআনের আয়াত নাযেল হয়- “নিশ্চয় ওই সব লোক যারা আপনাকে হুজরাসমূহের (প্রকোষ্ঠ) বাইরে থেকে আহ্বান করে তাদের মধ্যে অধিকাংশই নির্বোধ এবং যদি তারা ধৈর্য ধারণ করতো আপনি তাদের কাছে বের হওয়া পর্যন্ত, তবে তা তাদের জন্যে ভাল হতো।” (সূরা হুজুরাত, ৪-৫ আয়াত)। তোমার পীরের সাথে কথাবর্তা বলার সময় যেমন তুমি খোলামেলা হবে না, তেমনি কাজে কর্মেও তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাকে তোমার কর্তব্য মনে করবে। তাই পীরের দরবারে তোমার জায়নামাজ শুধু নামাযের সময় হলেই বিছিয়ে দেবে। তাঁর সামনে সূফীবৃন্দের সেমা (কাওয়ালী/মরমী সংগীত) শোনার সময় যতোক্ষণ তোমার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে, ততোক্ষণ চিৎকার বা ওয়াজদ (দৈনিক স্পন্দন) করবে না। হাসাহাসিও করবে না।
এগারোতম আদব তোমার প্রতি শর্তারোপ করে যে, কথা বলার সঠিক সময়টুকু তোমার জানা প্রয়োজন। মুরীদ যখন ধর্মীয় বা বৈষয়িক গুরুত্বপূণ বিষয় সম্পর্কে আলাপ করতে চায়, তখন তার উচিৎ এটা দেখে নেয়া যে তার পীর এ ব্যাপার তার মূল্যবান সময় দিতে রাজি আছেন কিনা; অর্থাৎ, তিনি মুরীদের কথা শুনতে ইচ্ছুক কিনা। তোমার শায়খের সাথে কথা বলার সময় তোমার তাড়াহুড়ো করা উচিৎ নয়। আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা কামনা করো যাতে করে আদব পালনের ক্ষেত্রে কোনো ভুল-ত্রুটি না হয়ে যায়, কোনো বেয়াদবী না হয়ে যায়। এ সময় খোদা তা’লার এতো নিকটবর্তী হওয়ার কারণে পীরের দরবারে হাদিয়া পেশ করা যথোচিৎ হবে। মহানবী (দ:)-এর দরবারেও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর কাছে কিছু আরয করার আগে এ রকম হাদিয়া পেশ করতেন, যেমনিভাবে কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছে; “হে ঈমানদারবৃন্দ! তোমরা যখন রাসূল (দ:)-এর কাছে কোনো কথা গোপনে আরয করতে চাও, তবে তা করার আগে কিছু সাদকাহ্ (হাদিয়া) পেশ করো (রাসূলের কাছে)” (সূরা মুজাদালা, ১২ আয়াত)।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরকার শিরোমণি হযরত ইবনে আব্বাস (রা: বেসাল- ৬৮৭/৯০ খৃষ্টাব্দ) বলেন: “এ আয়াতটি অবতীর্ণ হবার কারণ হলো মানুষেরা হুজুর পূর নূর (দ:)-এর দরবারে হাজির হয়ে মাত্রাতিরিক্ত পীড়াপীড়িমূলক প্রশ্ন করতো এবং তাঁকে পেরেশান করতো।”
বারোতম আদব দাবি করে যে তুমি তোমার আধ্যাত্মিক মকামের সীমানাগুলো পাহারা দেবে। পীরকে প্রশ্ন করার সময় মুরীদের উচিৎ নিজ মকামের সীমা বজায় রাখা। শুধু তোমার আধ্যাত্মিক অবস্থা-সম্পর্কিত তোমার কাছ থেকে গোপন বা আড়াল যে কোনো বিষয় সম্পর্কেই তুমি তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারবে। অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করো না; এটা তোমার মকাম বা হালের সাথে সম্পর্কিত এমন বিষয়গুলোর বেলায়ও প্রযোজ্য। অতএব, এগুলো সম্পর্কে পীরের সাথে আলাপ করো না; কেননা এগুলো উপকারী নয়, এমন কি ক্ষতিকরও হতে পারে। তোমার আধ্যাত্মিক অবস্থার সাথে যা কিছু জড়িত শুধু সে সম্পর্কেই প্রশ্ন করবে। এ ধরনের বাহুল্য প্রশ্নের ব্যাপারে কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে- “হে ঈমানদারবৃন্দ! তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যেগুলো তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হলে তোমাদের খারাপ লাগবে” (সূরা মাঈদাহ, ১০১ আয়াত)। উপকারী কথা হলো তা-ই যা শ্রোতার উপলব্ধি ক্ষমতার অনুকূল। আর উপকারী প্রশ্ন হলো তা-ই যা উত্তর শ্রবণকারীর মকামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তেরোতম আদব হলো তুমি তোমার পীরের গোপন রহস্য সম্পর্কে চুপ থাকবে। অলৌকিক ক্ষমতা, স্বপ্ন ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক বিষয় যা তোমার পীর গোপন রেখেছেন, তা প্রকাশ করার জন্যে তুমি অনুমতি চাইবে না। কেননা, এগুলো গোপন রাখার মাঝে তোমার পীর কোনো ধর্মীয় কিংবা দুনিয়াবী কল্যাণ দেখতে পেয়েছেন যা সম্পর্কে তুমি অবগত নও। এগুলো প্রকাশ করলে ক্ষতি হতে পারে।
এ আদবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মুরীদের সেই সব গোপন বিষয় যা পীরের জানা এবং যা পীরের কাছে গোপন রয়েছে। নিচের পংক্তিগুলো তাঁর হাল বর্ণনা করে:
’অনেক আন্তরিক ও মহৎ মানুষ আমার জানা,
যাদের গোপন বিষয় আমি অন্যদের থেকে করেছি আড়াল,
এসব যবে আমি রেখেছি আমা মাঝে লুকিয়ে,
প্রতিটি অন্তরেই রয়েছে মুক্ত একটি আঙ্গিনা,
যা এমনই রাজ্য যেখানে করা যায় ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা,
কাঙ্ক্ষিত নয় যার প্রকাশ ও প্রচারণা’।
চৌদ্দতম আদবের শর্ত এই যে, তুমি তোমার গোপন বিষয়গুলো তোমার পীরের কাছে প্রকাশ করবে। তা গোপন রাখার কোনো অনুমতি নেই। খোদা তা’লার তরফ থেকে তোমার প্রতি যে পুরস্কার বর্ষিত হয়েছে তার সবই পরিষ্কার ভাষায় ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সহকারে পীরের কাছে ব্যক্ত করবে, যাতে করে তিনি এগুলো সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, তোমার সজ্ঞানে কোনো ব্যক্তিগত গোপন বিষয় তাঁর কাছে গোপন রাখা হলো; এটি হয়তো পরবর্তী পর্যায়ে অন্তরে জট সৃষ্টি করতে পারে যার দরুণ হয়তো তোমার শায়খের কাছ থেকে উপদেশ ও সাহায্যপ্রাপ্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। তুমি এটা শায়খের খেদমতে পেশ করলে জট অপসারিত হবে।
পনেরোতম আদব দাবি করে যে তোমার পীর (কিংবা তাঁর কাছ থেকে তোমার কাছে আগত কিছু) সম্পর্কে অন্য কাউকে কিছু বলতে হলে তার উপলব্ধি ক্ষমতার সাথে বিষয়টি সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। এমন কোনো অস্পষ্ট কিংবা সূক্ষ্ম বিষয় তাকে বলো না যা সে বুঝতে অক্ষম। এটা তার জন্যে অর্থহীন, এমন কি ক্ষতিকরও হতে পারে। ওই ব্যক্তি হয়তো তোমার পীরের প্রতি বদ ধারণাও পোষণ করতে পারে।
মুরীদ এসব আদব পালন করলে খোদায়ী করুণার নূর (জ্যোতি/আলো) এবং তাঁর অফুরন্ত নেয়ামত (আশীর্বাদ) তোমার প্রতি অবতীর্ণ হবে; যার প্রতি তোমার লক্ষ্য ছিল তা তোমার যাহেরী (প্রকাশ্য) ও বাতেনী (অপ্রকাশ্য) সত্তায় প্রকাশ পাবে এবং তুমি খাস্ (বিশেষ) দলে নিজ স্থান করে নেবে। লক্ষ্য করো যে, ওপরে উদ্ধৃত ১৫টি আদব কেবলমাত্র যথাযথ আচরণ উপলব্ধি করার জন্যেই, যাতে করে শিক্ষা দান ও তা গ্রহণ সংঘটিত হতে পারে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে প্রতিটি সূফী তরীকা ও পীর মাশায়েখবৃন্দ এ সব আদবের সংস্কার সাধন করতে পারেন।
[মাহমুদ কাশানীর রচিত ‘মিসবাহ্ আল হেদায়া ওয়া মিফতাহ্ আল কেফায়া’ - “সঠিক পথের চেরাগ ও পর্যাপ্ত জ্ঞানের চাবিকাঠি” শীর্ষক পুস্তকের ১৫টি আদব অনুবাদ এখানে সমাপ্ত হলো)।
[এটি www.zahuri.org/article8.html শীর্ষক ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে]