প্রিয় নবী (দ:)-এর আকিদা-বিশ্বাস
(১) হযরত বুরায়দা (রা:) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে খোদা এরশাদ ফরমান, “ইতিপূবে আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে যেয়ারত করো (মুসলিম শরীফ, মেশকাত ১৫৪ পৃষ্ঠা)।
এ হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দীসে দেহেলভী (রাহ:) লিখেছেন যে, অজ্ঞতার যুগ সবেমাত্র পার হওয়ায় রাসূলুলাহ (দ:) কবর যেয়ারত নিষেধ করেছিলেন এই আশংকায় যে মুসলমানরা পুরনো জীবনধারায় প্রত্যাবর্তন করবেন। তবে মানুষেরা যখন ইসলামী ব্যবস্থার সাথে ভালভাবে পরিচিত হলেন, তখন প্রিয় নবী (দ:) যেয়ারতকে অনুমতি দিলেন (আশ্আতুল লোমআত, ১ম খন্ড, ৭১৭ পৃষ্ঠা)।
(২) হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত, হযরত নবী করীম (দ:) এরশাদ করেন, “আমি তোমাদের কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে যেয়ারত করো” (ইবনে মাজাহ, মেশকাত পৃষ্ঠা ১৫৪)।
(৩) মোহাম্মদ বিন নোমান (রা:) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান, “যে ব্যক্তি প্রতি শুক্রবার তার পিতা-মাতার বা তাঁদের যে কোনো একজনের কবর যেয়ারত করে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং পুণ্যবানদের একজন হিসেবে তার নাম লেখা হবে” (মেশাকাত, ১৫৪ পৃষ্ঠা)।
এ সকল হাদীস থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে প্রিয় নবী (দ:)-এর কাছে কবর যেয়ারত বৈধ। উপরস্তু, যে ব্যক্তি প্রতি শুক্রবার তাঁর পিতামাতার কবর যেয়ারত করেন, তাঁর গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।
ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর আকিদা-বিশ্বাস
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রহ:) ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, “আমি ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর মাযার যেয়ারত করি। আমার যখন কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় তখন আমি দু’রাকাত নামায আদায় করে ইমাম আবু হানিফা (র:)-এর মাযার যেয়ারত করি এবং তৎক্ষণাৎ আমার প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়” (রাদ্দুল মোহ্তার, ১ম খণ্ড, ৩৮ পৃষ্ঠা)।
শায়খ আব্দুল হক দেহেলভীও লিখেন: “ইমাম শাফেয়ী (রহ:) বলেছেন যে হযরত মূসা কাযেমের (রহ:) মাযারে তাৎক্ষণিক দোয়া কবুল হয়” (আশ্আতুল লোমআত, ১ম খণ্ড, ৭১৫ পৃষ্ঠা)।
এ সকল লেখনীতে প্রতিভাত হয় যে, ইমাম শাফেয়ীর (রহ:) এ মর্মে আকিদা-বিশ্বাস ছিল আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার যেয়ারত করে তা থেকে সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ এবং মাযারস্থ আউলিয়ায়ে কেরাম বিপদ-আপদ দূর করার একটি মাধ্যম, এ বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করাও বৈধ।
ইমাম সাবী মালেকী (রাহ:)-এর আকিদা-বিশ্বাস
“আল্লাহর নৈকট্যের জন্যে ওসীলা অন্বেষণ করো”- আল্ কুরআন (৫:৩৫)-এর এই আয়াতটি ব্যাখ্যাকালে ইমাম সাবী (রহ:) বলেন. “আল্লাহ্ ভিন্ন অপর কারো এবাদত-বন্দেগী করছেন মনে করে আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার যেয়ারতকারী মুসলমানদেরকে কাফের আখ্যা দেয়া স্পষ্ট গোমরাহী। তাঁদের মাযার যেয়ারত করা আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারো এবাদত-বন্দেগী নয়, এটা হলো আল্লাহ্ যাঁদেরকে ভালোবাসেন তাঁদেরকে ভালোবাসার নিদর্শন” (তাফসীরে সাবী, ১ম খণ্ড, ২৪৫ পৃষ্ঠা)।
ইমাম সাবী (রহ:)-এর এই ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায় যে আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার যেয়ারত বৈধ এবং এটা আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারো পূজা-অর্চনা নয়, বরং আল্লাহ্ যাঁদেরকে ভালোবাসেন তাঁদেরকে ভালোবাসার নির্দশন।
সুলতানুল মাশায়েখ হযরত নিযামউদ্দীন আউলিয়ার আকিদা-বিশ্বাস
হযরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া (রহ:) বলেন যে মওলানা কাটহেলী একবার তাঁর নিজের ঘটনা বর্ণনা করেন: কোনো এক বছর দিল্লীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আমি একটি বাজার এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলাম আর তখন আমার খিদে পেয়েছিল । আমি কিছু খাবার কিনে মনে মনে বল্লাম, এ খাবার আমার একা খাওয়া উচিৎ নয়; এটা কারো সাথে ভাগাভাগি করতে হবে। এমতাবস্থায় আমি এক বৃদ্ধ মানুষের দেখা পেলাম যাঁর গায়ে চাদর মোড়ানো ছিল। আমি তাঁকে বল্লাম, ওহে খাজা! আমি গরিব এবং আপনাকেও গরিব মনে হচ্ছে। মওলানা কাটহেলী ওই বৃদ্ধকে খাবার গ্রহণের জন্যে আমন্ত্রণ জানালেন এবং তিনি তা গ্রহণ করলেন। মওলানা কাটহেলী বলেন, আমরা যখন খাচ্ছিলাম তখন আমি ওই বয়স্ক মরুব্বীকে জানালাম যে আমি ২০ টাকা (রূপী) ঋণগ্রস্ত। এ কথা শুনে ওই বয়স্ক মরুব্বী আমাকে খাওয়া চালিয়ে যেতে তাগিদ দিলেন এবং ওই ২০ টাকা (রূপী) এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমি আপন মনে ভাবলাম, তিনি এই টাকা পাবেন কোথায়? খাওয়া শেষে সেই বয়স্ক মরুব্বী উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে মসজিদে নিয়ে গেলেন। এই মসজিদের ভেতরে একটি মাযার অবস্থিত ছিল। তিনি ওই মাযারের কাছে কী যেন চাইলেন। তাঁর হাতে যে ছোট লাঠি ছিল তা দ্বারা দু’বার মাযারে আলতোভাবে ছুঁয়ে তিনি বল্লেন, এই লোকের ২০ টাকা প্রয়োজন, তাকে তা দেবেন। অতঃপর বয়স্ক মরুব্বী আমার দিকে ফিরে বল্লেন, ‘মওলানা, ফিরে যান; আপনি আপনার ২০ টাকা পাবেন।’
আমি এ কথা শুনে ওই মরুব্বীর হাতে চুমো খেলাম এবং শহরের দিকে ফিরে চল্লাম। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কীভাবে আমি ওই ২০ টাকা খুঁজে পাবো। আমার সাথে একটা চিঠি ছিল যা কারো বাসায় আমাকে পৌঁছে দেবার কথা ছিল। ওই চিঠি যথাস্থানে নিয়ে গেলে আমি জনৈক তুর্কী ব্যক্তির দেখা পাই। তিনি তাঁর গৃহ-ভৃত্যদের বল্লেন আমাকে ওপর তলায় নিয়ে যাবার জন্যে। আমি তাঁকে চেনার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না, কিন্তু তিনি বার বার বলছিলেন কোনো এক সময় নাকি আমি তাঁকে সাহায্য করেছিলাম। আমি তাঁকে না চেনার কথা বল্লেও তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন বলে জানালেন। আমরা এভাবে কিছুক্ষণ কথাবর্তা বল্লাম। অতঃপর তিনি ভেতর থেকে ফিরে এসে আমার হাতে ২০ টাকা গুজে দিলেন (ফাওয়াইদ আল ফাওয়াদ, ১২৪ পৃষ্ঠা)।
হযরত নিযামউদ্দীন আউলিয়া (রহ:)-এর বর্ণিত এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে তিনি এ মর্মে বিশ্বাস পোষণ করতেন যে আউলিয়ায়ে কেরাম যাহেরী জিন্দেগীতে থাকাকালীন সময়ে যেভাবে মানুষদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম, ঠিক একইভাবে মাযারস্থ অবস্থায়ও তাঁরা মানুষদেরকে আধ্যাত্মিক সাহায্য দিতে সক্ষম। আর তাঁদের কাছে এই সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ। প্রকৃত দাতা হলেন আল্লাহ তা’লা; আউলিয়ায়ে কেরাম আমাদের সাহায্য করেন আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে; যেমনিভাবে প্রকৃত আরোগ্য দানকারী হলেন আল্লাহ্ পাক, কিন্তু রোগীরা আরোগ্যের জন্যে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
আল্লামা জামী (রহ:)-এর আকিদা-বিশ্বাস
আল্লামা জামী (রহ:) শায়খ আবুল হারিস আওলাসী (রহ:)-কে উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন যে হযরত যুন্নূন মিসরী (রহ:) সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু শুনেছেন। তাই কিছু মাসআলা সম্পর্কে জানতে আল্লামা জামী (রহ:) তাঁর সাথে দেখা করার কথা মনস্থ করেন। কিন্তু যখন তিনি মিসর পৌঁছেন তখন জানতে পারেন যে হযরত যুন্নূন মিসরী (রহ:) বেসালপ্রাপ্ত (খোদার সাথে পর পারে মিলিত) হয়েছেন। এমতাবস্থায় আল্লামা জামী (রহ:) তাঁর মাযারে যান এবং মোরাকাবায় বসেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি হয়রান বোধ করেন এবং ঘুমিয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি হযরত যুন্নূন মিসরী (রহ:)-কে স্বপ্নে দেখেন এবং তাঁর প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেন। শায়খ মিসরী তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দেন এবং তাঁর কাঁধ থেকে বোঝা নামিয়ে দেন (নাফহাত আল্ উনস্ ১৯৩ পৃষ্ঠা)।
এ ঘটনার কথা উল্লেখ করে আল্লামা জামী (রহ:) তাঁর আকিদা-বিশ্বাস স্পষ্ট করলেন এ মর্মে যে, কোনো প্রয়োজন নিয়ে আউলিয়ায়ে কেরামের মাযারে যাওয়া বৈধ। তাঁরা আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আমাদেরকে সাহায্য করে থাকেন।
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী শাফেয়ী (রহ:)-এর আকিদা
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহ:) লিখেন, উলামা ও যাদের প্রয়োজন তাঁদের মধ্যে এই আচার সবসময়ই চালু ছিল যে তাঁরা ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর মাযারে যেতেন এবং নিজেদের অসুবিধা দূর করার জন্যে তাঁর মাধ্যমে দোয়া করতেন। এ সকল ব্যক্তি এটাকে সাফল্য লাভের একটা ওসীলা মনে করতেন এবং এর অনুশীলন দ্বারা বড় ধরনের পুরস্কার লাভ করতেন। বাগদাদে থাকাকালীন সব সময়েই ইমাম শাফেয়ী (রহ:) ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর মাযারে যেতেন এবং তাঁর কাছে আশীর্বাদ তালাশ করতেন। যখন আমার (ইমাম ইবনে হাজর) কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন আমি দু’রাকাত নামায আদায় করে তাঁর মাযারে যাই এবং তাঁর ওসীলায় দোয়া করি। ফলে আমার অসুবিধা তক্ষণি দূর হয়ে যায় (খায়রাত আল্ হিসান, ১৬৬ পৃষ্ঠা)।
এ লেখনী থেকে পরিস্ফুট হলো যে, ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহ:) বুযুর্গানের দ্বীনের মাযার যেয়ারত ও তাঁদের ওসীলা গ্রহণকে বৈধ জানতেন এবং ইমাম শাফেয়ীও (রহ:) এর ওপর আমলকারী ছিলেন।
শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী (রহ:)-এর আকিদা
শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী (রহ:) লিখেন: “কবর যেয়ারত করা মোস্তাহাব (প্রশংসনীয়) এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে” (আশআতুল লোমআত, ১ম খণ্ড, ৭১৫ পৃষ্ঠা)। তিনি আরও লিখেন: “যেয়ারতের সময় কবরস্থদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব (অবশ্য কর্তব্য), বিশেষ করে পুণ্যবান বান্দাদের ক্ষেত্রে। তাঁরা যাহেরী জিন্দেগীতে থাকাকালীন তাঁদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা যেমন প্রয়োজনীয় ছিল, একইভাবে তাঁদের মাযারেও তা প্রদর্শন করা জরুরি। কেননা, মাযারস্থ বুযুর্গানে দ্বীন যে সাহায্য করে থাকেন, তা তাঁদের প্রতি যেয়ারতকারীদের প্রদর্শিত ভক্তি-শ্রদ্ধার ও সম্মানের ওপরই নির্ভর করে” (আশআতুল লোমআত, ১ম খণ্ড, ৭১০ পৃষ্ঠা)।
এ লেখনী থেকে পরিস্ফুট হয় যে শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী (রহ:) আউলিয়ার মাযার যেয়ারত ও তাঁদের তওয়াসসুল (মধ্যস্থতা) গ্রহণকে শেরক বা বেদআত বলে জানতেন না। উপরন্তু তাঁর মতে এটা পছন্দনীয় কাজ এবং এর দ্বারা যেয়ারতকারীরা মাযারস্থ বুযুর্গানের দ্বীনের সাহায্য পান ও আশীর্বাদধন্য হন।
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ দেহেলভীর আকিদা-বিশ্বাস
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ লিখেন যে তাঁর পিতা শাহ্ আব্দুর রহীম বলেছেন, “একবার আমি হযরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতেয়ার বাকী (রহ:)-এর মাযার শরীফ যেয়ারত করতে যাই। এমতাবস্থায় তাঁর রূহ্ মোবারক আমার সামনে দৃশ্যমান হন এবং আমাকে বলেন যে আমার একজন পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করবে, আর আমি যেন ওর নাম রাখি কুতুবউদ্দীন আহমদ। ওই সময় আমার স্ত্রী বয়স্ক হয়ে গিয়েছিল এবং সন্তান ধারণের বয়স পেরিয়েছিল। তাই শায়খের এ কথা শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম সম্ভবত আমার নাতি হতে যাচ্ছে। হযরত বখতেয়ার কাকী (রহ:) আমার মনের কথা বুঝতে পেরে সন্দেহ দূর করে দিলেন এ কথা বলে যে তিনি নাতির খোশ-খবরী (শুভ সংবাদ) দেন নি, বরং আমার নিজের একজন পুত্র সন্তানের কথা বলেছেন। কিছু কাল পরে আমি আবার বিয়ে করি এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে (শাহ্) ওয়ালিউল্লাহর জন্ম হয়।” শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ বলেন, ’আমার জন্মের সময় আমার বাবা ওই ঘটনার কথা ভুলে গিয়েছিলেন আর তাই আমার নাম রেখেছিলেন ওয়ালিউল্লাহ্। তাঁর যখন এ ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়, তখন তিনি আমার দ্বিতীয় নাম রাখেন কুতুবউদ্দীন আহমদ। (আনফাস্ আল্ আরেফীন, ১১০ পৃষ্ঠা)।
এ ঘটনা বর্ণনা করে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ তাঁর বিশ্বাস সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণা আমাদের দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পুণ্যবান আউলিয়াবৃন্দের মাযারে যাওয়া জায়েয এবং বেসালের পরও আউলিয়ায়ে কেরামের কাছে গায়েবের খবর জানা আছে, যেমনটি হযরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতেযার কাকী (রহ:) ওই পুত্র সন্তানের জন্মের এক বছর আগে এ সম্পর্কে জানতেন। উপরস্তু, মাযারস্থ বুযুর্গানে দ্বীন মনের খবরও জানেন।
শাহ্ আব্দুল আযীয দেহেলভীর আকিদা-বিশ্বাস
শাহ্ আব্দুল আযীয লিখেন: “শরহে মাকাসিদ গ্রন্থে লেখা আছে যে মাযার যেয়ারত করা উপকারী এবং মাযারস্থ আউলিয়ায়ে কেরামের রূহ্ মোবারক উপকার সাধন করতে সক্ষম। বাস্তবিকই বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলিত)-প্রাপ্ত হবার পরে আউলিয়ায়ে কেরামের রূহ্ মোবারক তাঁদের শরীর ও মাযারের সাথে সম্পর্ক রাখেন। তাই কেউ যখন কোনো ওলীর মাযার যেয়ারত করেন এবং ওই ওলীর প্রতি মনোযোগ দেন, তখন উভয় রূহের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করা হয়েছে যে আউলিয়ায়ে কেরাম জীবিতাবস্থায় বেশি সাহায্য করতে সক্ষম না বেসালপ্রাপ্ত অবস্থায়। কিছু উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে বেসালপ্রাপ্ত আউলিয়া বেশি সাহায্য করতে সক্ষম; আর কিছু উলামা হুজুর পূর নূর (দ:)-এর একটি হাদীস এ মতের স্বপক্ষে পেশ করে তা প্রমাণ করেছেন; হাদীসটিতে এরশাদ হয়েছে, ইযা তাহাই-ইয়্যারতুম ফীল উমুরে, ফাসতা’ঈনূ মিন আহলিল কুবূর -
অর্থ: ’যখন তোমরা কোনো ব্যাপারে পেরেশানগ্রস্ত হও, তখন মাযারস্থ (আউলিয়া)-দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো’। শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী (রহ:) শরহে মেশকাত গ্রন্থে বলেছেন যে এই বিষয়টির পরিপন্থী কোনো দালিলিক প্রমাণ কুরআন ও সুন্নাহ্ কিংবা সালাফবৃন্দের বাণীতে বিদ্যমান নেই (ফতোওয়ায়ে আযীযিয়া, ২য় খণ্ড, ১০৮ পৃষ্ঠা)।
ফতোওয়ায়ে আযীযিয়ার এই উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে পুণ্যবান আউলিয়ার মাযার যেয়ারত করা উত্তম একটি আমল এবং তাঁদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা শরীয়তে জায়েয (বৈধ)।
[এ লেখাটি www.aqdas.co.uk শীর্ষক ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে]
“ইয়া শায়খ মদদ” বলে পীর-বুযূর্গদের আহ্বান করা
মূল: ড: জি, এফ, হাদ্দাদ দামেশ্কী
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
‘আল মদদ’=সাহায্য করুন!
এই মদদ হযরত মূসা (আ:) তাঁর জাতির মধ্যে জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে ‘এসতেগাসা’ শব্দটি ব্যবহার করে চেয়েছিলেন, যা কুরআন মজীদে বর্ণিত হয়েছে - “তিনি সাহায্য চেয়েছিলেন” (আল্ কুরআন ২৮:১৫)। একইভাবে যুলকারনাইন (আ:)-ও সূরা কাহাফ (১৮-৯৫)-এ “আঈনূনী” (আমায় সাহায্য করুন) বলেছিলেন, যা সূরা ফাতিহায় ব্যবহৃত “নাসতাঈন’ শব্দের একই মূল (শব্দ) থেকে এসেছে।
চাহিদা পূরণের জন্যে বা প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে অদৃশ্য সাহায্যকারীকে আহ্বান করার প্রমাণ হিসেবে নিচে কিছু শরয়ী দলিল পেশ করা হলো:
(১) আল-বুখারীর সহীহ্ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে আমাদের মা হাজেরা যখন সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটোর মধ্যে পানির জন্যে ছুটোছুটি করছিলেন, তখন তিনি একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে উচ্চস্বরে বলে ওঠেন, “ওহে, আমায় যে কণ্ঠস্বর শুনিয়েছ। যদি এখানে কোনো গাউস (সাহায্য/সাহায্যকারী) তোমার সাথে থেকে থাকে, তবে আমায় সাহায্য করো!” এমতাবস্থায়, যমযম ফোয়ারার স্থানে একজন ফেরেশতা আবির্ভূত হন।
(২) আবু ইয়া’লা, ইবনুল সুন্নী এবং তাবরানী নিজ প্রণীত আলা মু’জামূল কবীর গ্রন্থে বর্ণনা করেন রাসূলে খোদা (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ করেন ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো কিছু হারালে ও সাহায্য বা সাহায্যকারী (গাউস)-এর খোঁজ করলে এবং সে বন্ধুহীন এমন কোনো দেশে থাকলে, সে যেন উচ্চস্বরে বলে: ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমাকে সাহায্য করুন’(ইয়া ইবাদাল্লাহি, আগিসুনী); কেননা নিশ্চয় আল্লাহর এমন কিছু বান্দা আছেন যাদের কেউ দেখতে পায় না।” আল্ হায়তামী তাঁর মজমাউল জওয়াইদ গ্রন্থে (১০:১৩২) বলেন, “এ হাদীস বর্ণনাকারীদের সনদ (পরম্পরা) নির্ভরযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে”।
অপর এক বর্ণনায় আছে-
(৩) হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর কাছ থেকে ইমাম বায়হাকী (রহ:) তাঁর “কিতাবুল আদাব’ (পৃষ্ঠা ৪৩৬) গ্রন্থে এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে দ্বিতীয় একটি মওকুফ সনদে “শুআবুল ঈমান” (১:৮৮৫-৪৪৬=১:১৮৩#১৬৭;৬:১২৮#৭৬৯৭) গ্রন্থে এবং হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে তৃতীয় আরেক সনদে ‘হায়াতুল আম্বিয়া বা’দা ওয়াফাতিহীম’ (পৃষ্ঠা ৪৪) গ্রন্থে বর্ণনা করেন নবী করীম (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান- “কেরামান কাতেবীন (দুই কাঁধে অবস্থিত হিসেব রক্ষক) ফেরেশতা দু’জন ছাড়াও আল্লাহ্ তা’লা পৃথিবীতে আরও ফেরেশতা পাঠিয়েছেন যারা মাটিতে পাতা পড়লে তারও হিসেব রাখেন। অতএব, মরুতূমিতে কেউ যদি অচল হয়ে পড়ে সে যেন উচ্চস্বরে বলে: আঈনু ইবাদাল্লাহ্ রাহিমাকুম আল্লাহ (অর্থাৎ, ওহে আল্লাহর বান্দাগণ! আমাকে সাহায্য করুন; আল্লাহ আপনাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন); নিশ্চয় আল্লাহ চাইলে তাকে সাহায্য করা হবে।” ইমাম ইবনে হাজর তাঁর কৃত ‘আল আমলী’ গ্রন্থে এ সনদকে বিশুদ্ধ (ইসনাদুহু হাসান) বলেছেন। হাদীসটি হাসান সনদে তাবরানী তাঁর ‘আল কবীর’ পুস্তকে (ইবনে হাজর কৃত ‘আল আমলী’ অনুযায়ী) ও আল হায়তামী (১০:১৩২) এবং আল বাযযার (#৩১২৮)-এর মতানুযায়ী নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সনদে বর্ণিত হয়েছে যা শওকানীর তোহফাতুয্ যাকেরীন (পৃষ্ঠা ২১৯ = পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৬) পুস্তকে এবং ইবনে আবি শায়বা (৭:১০৩)-তেও উদ্ধৃত হয়েছে।
(৪) ইবনে আবি শায়বা তাঁর প্রণীত ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে (৭:১০৩) আবান ইবনে সালেহ থেকে বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ করেছেন- ‘তোমাদের মধ্যে কেউ মরুভূমিতে নিজের কোনো পশু বা উট হারালে আর সেখানে কারো দেখা না পেলে, সে যেন বলে: হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমায় সাহায্য করুন (ইয়া ইবাদাল্লাহী আঈনূনী)! নিশ্চয় তাকে সাহায্য করা হবে।” (আল হাদীস)
আয্ যাহাবী তাঁর লিখিত বাতেল মতবাদ খণ্ডনমূলক বই ’আল ফাজর আস্ সাদিক’-এ লিখেন: “হাদীসগুলোতে উদ্ধৃত আল্লাহর বান্দা বলতে শুধু জীবিত ফেরেশতা , মুসলমান জিন বা অদৃশ্য জগতের মানুষ বুঝিয়েছে এমন কথা কোথাও বলা হয় নি। হাদীসে বেসালপ্রাপ্ত ওলী বুযূর্গদের সাহায্য চাওয়ার প্রমাণ নেই এ কথাও ঠিক নয়। আমরা এ কথা বলছি এ কারণে যে, হাদীসগুলোতে প্রকাশ্যভাবে ‘আল্লাহর বান্দা’ বলতে শুধু আমাদের উল্লেখিত ওই তিন ধরনের সৃষ্টিকে বোঝানো হয় নি। যদি আমরা ধরেও নেই যে, শুধু ওই সব সৃষ্টিকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে, তাতেও বিরুদ্ধবাদীদের অপর একটি যুক্তিকে হাদীসগুলো খণ্ডন করে দেয়; আর তা হলো, অদৃশ্য কারো সাহায্য চেয়ে তাকে আহ্বান করা। বিরুদ্ধবাদীরা বেসালপ্রাপ্তদের কাছে সাহায্য প্রার্থনার চেয়ে এটিকে কোনো অংশেই কম খারাপ চোখে দেখে না এবং তাদের কাছে এরও কোনো অনুমতি নেই”।
শওকানী অদৃশ্য কাউকে আহ্বান করার বিষয়টির বৈধতা স্বীকার করে লিখেছেন: আ’ঈনূ হাদীসে প্রমাণিত হয় যে অদৃশ্য আল্লাহর বান্দাদের কাছে সাহায্য চাওয়া বৈধ, তাঁরা ফেরেশতা হোন আর মোমেন জিন-ই হোন; ঠিক যেমনি কারো ঘোড়া বা সওয়ার নিয়ন্ত্রণের বাইরে বা ছুটে গেলে মানুষের সাহায্য চাওয়া অনুমতিপ্রাপ্ত (তোহফাতুয-যাকেরীন, পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৬)।
(৫) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) তাঁর রচিত ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে দজ্জালের ফিতনা যখন চরম আকার ধারণ করবে এবং মুসলমানরা মহাবিপদে পড়বেন, এমতাবস্থায় হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) ফজরের নামাযের সময় অবতরণের আগ মুহূর্তে মানুষেরা একজন ঘোষককে তিনবার ঘোষণা দিতে শুনবেন - ‘ওহে মানুষেরা, আল্ গাউস (সাহায্যকারী) তোমাদের কাছে আসছেন’!
(৬) ইবনে কাসীর তাঁর ইতিহাস পুস্তক ’আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’ (৭:৯১, বছর ১৮)-তে বর্ণনা করেন যে খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর ফরুক (রা:) মদীনায় খরা ও দুর্ভিক্ষের সময় মিসরে অবস্থিত হযরত আমর ইবনুল আস (রা:) ও বসরায় অবস্থিত হযরত আবু মূসা আশআরী (রা:)-এর কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন যা’তে উভয়ের কাছে বলা হয়েছিল “ইয়া গাউসাহ লি উম্মাতি মোহাম্মদ (দ:)”! অর্থাৎ, ’উম্মতে মোহাম্মদীকে সাহায্য করুন!’ এটা যদি ইসতেগাসাহ ও ইস্তেয়ানা না হয়ে থাকে, তাহলে আর কোনটা হবে?
আয্ যাহাবী তাঁর লিখিত ফজরুস্ সাদেক পুস্তকে আরও বলেন, “ইমাম সুবকী, ইমাম কসতলানী নিজ আল্ মাওয়াহিবুল লাদুননিয়া গ্রন্থে, আস্ সামহুদী তাঁর তারিখুল মদীনা বইয়ে এবং আল্ হায়তামী তাঁর আল্ জওহারুল মুনাযযাম গ্রন্থে বলেছেন যে মহানবী (দ:) ও অন্যান্য নবী-রাসূল এবং পুণ্যবান আউলিয়ায়ে কেরামের সাহায্য প্রার্থনা করা হলো আল্লাহর কাছে চাওয়ার একটি মাধ্যম, যা তাঁদের উচ্চমর্যাদা ও সম্মানের ওয়াস্তে চাওয়া হয় (বে-জাহেহীম)। প্রার্থনাকারী প্রার্থনা-কবুলকারী খোদাতা’লার কাছে ওসীলা বা মধ্যস্থতাকারীর উচ্চমর্যাদার ওয়াস্তে সাহায্য চান। প্রকৃতপক্ষে যার কাছে চাওয়া হয় তিনি আল্লাহ্ তা’লা । মহানবী (দ:) ওয়াসিতা (মাধ্যম, বাহন)-মাত্র। অতএব, সাহায্য এটির সৃষ্টিতে (খালকান) ও অস্তিত্বে (ইজাদান) মূলতঃ খোদা তা’লা থেকে নিঃসৃত। আর মহানবী (দ:)-এর সাহায্য তাসাব্বুবান (কারণ) এবং কাসবান (খোদা প্রদত্ত)।
“সাধারণ মানুষেরা আরবীতে যে বলেন ইয়া আবদাল কাদের আদ্রিকনী (হে বড় পীর দস্তগীর, আমার দিকে কৃপার দৃষ্টি দিন), অথবা ইয়া বদবী, আল্ মদদ (হে আহমদ বদবী, সাহায্য করুন), এসব কথা মাজাযী বা রূপক অর্থে ধরে নিতে হবে - যেমনিভাবে বলা হয় ‘এ খাবার আমায় পরিতৃপ্ত করেছে’, অথবা ‘এ পানি আমার তৃষ্ণা মিটিয়েছে’, কিংবা ‘এ ওষুধ আমাকে আরোগ্য দিয়েছে’। খাদ্য বা পানি খিদে বা তেষ্টা মেটায় না। আর ওষুধও আরোগ্য দেয় না। বরং যিনি এগুলো করে থাকেন তিনি আল্লাহ্ তা’লা স্বয়ং। খাদ্য, পানি ও ওষুধ হলো তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় কারণ, মাধ্যম ও বাহনমাত্র।”
শায়খ খায়রুদ্দীন রমলী (রহ:)-কে ফতোওয়ায়ে খায়রীয়া (পৃষ্ঠা ১৮০-১৮১)-তে জিজ্ঞেস করা হয় সেইসব মানুষ সম্পর্কে যারা ভাবোন্মত্ত হয়ে ওয়াজদ (দেহ স্পন্দন) করেন এবং বলেন- “হে শায়খ আবদুল কাদের! অথবা ‘হে শায়খ আহমদ বদবী’! কিংবা ‘হে শায়খ রেফায়ী! আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের অমুক বস্তু দিন ( শাইয়্যান লিল্লাহ)। শায়খ রমলী (রহ:) জবাবে বলেন, “প্রথমেই জেনে রাখো, ইমামগণের বইপত্রে সর্বজনবিদিত যে নিয়ম চালু রয়েছে তা হলো সকল কর্ম তার নিয়্যত বা উদ্দেশ্য দ্বারা বিবেচিত হবে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে ‘নিশ্চয় আমল বা কর্ম নিয়্যত তথা অন্তরের উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভরশীল’। আর কেউই সূফীবৃন্দের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন না, একমাত্র অজ্ঞ-মূর্খ এবং বোকা ব্যক্তিবর্গ ছাড়া”। আল্লাহ্ তা’লাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
(এ লেখাটি www.sunnah.org/aqidah/madad.html ওয়েবসাইট থেকে ভাষান্তর করা হয়েছে)