NOTICE:- ------------------ ----------------- ---------------------------

বেলায়াত ও কুরবাত

বেলায়াত (ওলীত্ব) ও কুরবাত (নৈকট্য)
লী-এর অর্থ

সূফীবাদকে অনেক সময় সমালোচনা করা হয় এ মর্মে যে, এতে নাকি আউলিয়ায়ে কেরাম ও বুযূর্গানে দ্বীনের প্রতি “মাত্রাতিরিক্ত” সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এ সমালোচনার  লক্ষ্যবস্তু হলো মূলতঃ আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার-দরগাহ যেয়ারতকে কেন্দ্র করে আচরিত কিছু রীতি, যা কারো ধারণায় মকরূহ; কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমালোচনা ওলীত্বের মকাম (মর্যাদা)-কে কেন্দ্র করে নয়। গুটি কয়েক শাফেয়ী মযহাবের আলেম এ সব প্রথার কয়েকটিকে যদিও বা মুনকার কিংবা মকরূহ্ বলেছেন, তথাপি অন্যান্য আলেমে হক্কনী-রব্বানীবৃন্দ তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম খায়রুদ্দীন রমলী (রহ:) এ মত পোষণ করেন যে, যদি কোনো ব্যক্তি হালত্ (আধ্যাত্মিক ভাব) অবস্থায় অথবা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো ওলীর মাযারে নিজেকে সমর্পণের উদ্দেশ্যে মাটিতে পড়ে যায়, তাহলে তাঁর এ কাজ মুনকার নয়, মকরূহ্ও নয়; শেরক (অংশীবাদ) তো কোনোক্রমেই নয়। ইমাম রমলী (রহ:)-এর মতানুযায়ী ওই ব্যক্তির অবস্থা হযরত সাইয়্যেদুনা বেলাল (রা:)-এর মতো, যিনি সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর হযরত রাসূলে পাক (দ:)-এর রওযা শরীফে নিজের মুখমন্ডল ঘষেছিলেন। মহানবী (দ:)-এর বেসালের সময় তিনি সিরিয়ায় ছিলেন।

“সংস্কারের” নামে সোচ্চার কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ইদানীং যে নতুন প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হলো, এ সব আচার ও প্রথাকে ‘শেরক’ বলে আখ্যা দেয়া। তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি ‘ঈমান’ ও ‘আমল’ বিষয়ক সংজ্ঞার বা ধারণার ব্যাপারে একটি মৌলিক বিভ্রান্তি পরিস্ফুট করে। সত্য কথা হলো, আমল (কর্ম) কখনোই শেরক হতে পারবে না, যদি না তার সাথে মুশরেকী বিশ্বাস বা মনোভাব কাজ করে। এ ক্ষেত্রেও ‘কর্ম’ শেরক নয়, বরং ‘বিশ্বাস’ বা মনোবৃত্তিই হলো শেরক। ‘আমল’ বা কর্মকে শেরক বলা ভুল যুক্তি। যদি তা সঠিক হতো, তবে হযরত বেলাল (রা:)-ও একজন মুশরিক হতেন (নাউযুবিল্লাহ্) [হযরত খালেদ বিন যায়দ আবু আইয়ুব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতেও অনুরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় - অনুবাদক]। কুরআনে বর্ণিত ফেরেশতাবৃন্দ কর্তৃক হযরত আদম (আ:)-কে সম্মান প্রদর্শন এবং হযরত ইউসুফ (আ:)-এর ভাইদের দ্বারা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনও একই বিবেচনার আওতায় পড়তো।

বিতর্কের কোনো বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আমরা বেলায়াতের মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে চাই। বেলায়েতের মকাম (মর্যাদা) কেন এতো কাঙ্ক্ষিত? ওলী বলতে কী বোঝায় এবং আউলিয়ায়ে কেরাম কি কারামত প্রদর্শন করেন? কেউ ওলী হলে তা কি তিনি জানতে পারেন? মানুষেরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, “আমরা শুনে থাকি যে ওলীবৃন্দের বিভিন্ন শ্রেণী বিন্যাস এবং পদ বিন্যাসও আছে; এ কথা কি সত্য”?

এ বিষয়ে আমরা প্রথমে কিছু কুরআনের আয়াত ও হাদীসে শরীফ বিশ্লেষণ করবো: হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) থেকে ইমাম আবদুল করীম কুশাইরী (রহ:) একটি হাদীসে কুদসী বর্ণনা করনে যা’তে রাসূলে করীম (দ:) এরশাদ ফরমান- “আল্লাহ্ তা’লা বলেন: যে ব্যক্তি কোনো ওলী (আল্লাহর বন্ধু)-কে আঘাত দেয়, সে আমার সাথে যুদ্ধ করাকে বৈধ জ্ঞান করেছে। আমার বান্দা আর কোনো এবাদত দ্বারা এমন নৈকট্য পান না যা তিনি পান ফরয এবাদত দ্বারা; নফল এবাদত পালন করে তিনি আমার আরও নিকটবর্তী হন; এতোখানি হন যে আমি তাঁকে ভালবাসি। আমি কদাচিৎ কোনো কিছু করতে দ্বিধান্বিত হই- যতোটা না দ্বিধান্বিত হই আমার বিশ্বাসী বান্দার জান কবজ করতে; কেননা তিনি মুত্যুকে অপছন্দ করেন আর আমিও অপছন্দ করি ক্ষতি করতে; কিন্তু মুত্যৃ থেকে রক্ষা নেই।”

ইমাম নববী (রহ:) হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত একখানা হাদীসে কুদসী রওয়ায়াত করেন যা’তে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ করেন- “নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার ওলীর প্রতি আঘাত দেয়, আমি তার প্রতি যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা আর কোনো এবাদত দ্বারা এমন নৈকট্য পায় না যা তিনি পান ফরয এবাদত পালনের মাধ্যমে; নফল এবাদত পালন করে তিনি আমার আরও নিকটবর্তী হন, এতোখানি হন যে আমি তাঁকে ভালবাসি। আর আমি যখন তাঁকে ভালবাসি, আমি তাঁর কুদরতী কান হই যা দ্বারা তিনি শুনেন; তাঁর কুদরতী চোখ হই যা দ্বারা তিনি দেখেন; তাঁর কুদরতী হাত হই যা দ্বারা তিনি কাজ করেন; তাঁর কুদরতী পা হই যা দ্বারা তিনি চলাফেরা করেন। তিনি আমার কাছে কিছু চাইলে তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর করি; আমার কাছে আশ্রয় চাইলে তাও দেই।” (মেশকাতুল মাসাবিহ)।

ইবনে হাব্বান (রহ:) ও নাসায়ী (রহ:) উভয়েই বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ করেছেন- “আল্লাহর বান্দাদের এমন একটি দল রয়েছেন যাঁদেরকে এমন কি (অন্যান্য) নবীবৃন্দ ও শুহাদা (শহীদ)-বর্গও ঈর্ষা করবেন।” এমতাবস্থায় কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (দ:)! এঁরা কারা, যাতে করে আমরা তাঁদেরকে ভালবাসতে পারি”? অতঃপর হুজুর পূর নূর (দ:) এরশাদ ফরমালেন, “তাঁরা এমনই একদল মানুষ, যারা আল্লাহ্ তা’লার নূরের আলোকে পরস্পরকে ভালবাসেন, অর্থ কিংবা পারিবারিক বন্ধনের কারণে নয়। তাঁদের চেহারা নূরে পরিপূর্ণ এবং তাঁরা নূরের মিম্বরে আরোহণ করেছেন। মানুষেরা যখন ভয় পায় তখন তাঁরা ভয় পান না; মানুষেরা যখন সন্তাপ করে, তখনও তাঁরা তা করেন না।” এর পর মহানবী (দ:) নিচের আয়াতটি তেলাওয়াত করেন-

”আলা ইন্না আউলিয়া-আল্লাহে লা খাউফুন আলাইহিম ওয়া লা হুম ইয়াহযানুন”

অর্থ: “আল্লাহর আউলিয়াবৃন্দের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা সন্তাপগ্রস্ত হবেন না” (সূরা ইউনুস, ৬২ আয়াত)।

আয়াতোল্লিখিত ‘আউলিয়া’ শব্দটি হলো ‘ওলী’ শব্দের বহুবচন। এ শব্দটি দু’টি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আরবী ভাষায় সাধারণতঃ ‘ওলী’ শব্দের অর্থ হলো বন্ধু, সহযোগী, মিত্র। এ অর্থে প্রত্যেক মো’মেন মুসলমানই আল্লাহর ওলী, কেননা তিনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন এবং তাঁর দ্বীনের সাথে নিজেকে সহযোগী হিসেবে সম্পৃক্ত করেন। মুসলমানদের প্রতি সাধারণভাবে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের জন্যে ইমাম আহমদ যাররুক আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে আমরা এ অর্থেও ওপরে উদ্ধৃত হাদীসগুলো উপলব্ধি করতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ্ তা’লা কোনো ওলীকে আঘাতদানকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে থাকেন। অন্যান্য মুসলমানদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ও আচরণ পরিহারে এটাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট ভয়-ভীতির হুমকি হওয়া উচিৎ। তবে ওলী শব্দটির আরও সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে যা নিচে দেয়া হলো:

(ক) এমন মুসলমানই হলেন ওলী, যিনি আল্লাহর এবাদতকে বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি কোনো পাপ না করে নিয়মিত এবাদত পালন করেন; কেননা তিনি পাপ থেকে (প্রায় পুরোপুরিভাবে) নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছেন। কিংবা,

(খ) এমন কোনো মুসলামন যাকে আল্লাহ পাক কবুল করে নিয়েছেন এবং নিজ হেফাযতে নিয়েছেন, যেমনিভাবে কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছে- “আমি উদ্ধার করে নিয়েছি ওই সব নেককার মানুষকে যারা অসৎ কর্ম থেকে নিবৃত্ত করতেন” (সূরা আ’রাফ ১৬৪ আয়াত)। এ আয়াতে প্রতিভাত হয় পূর্ণবান মুসলমানদেরকে আল্লাহ্ তা’লা গুনাহ থেকে হেফাযত করেন। এরই ফলশ্রুতিতে উলামায়ে কেরাম বলেন, নবীবৃন্দের অবস্থা হলো তাঁরা মা’সুম (নিষ্পাপ); আর ওলীবৃন্দের হলো তাঁরা মাহ্ফুয (পাপ হতে হেফাযতপ্রাপ্ত)।

বেলায়াত অর্জনে শরীয়তের প্রাধান্য

ওপরের আলোচনার ধারাবাহিকতায় বিষয়টির ক্ষেত্রে একটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন ইমাম কুশাইরী (রহ:)। তিনি বলেছেন, ‘কোনো ওলীকে ‘ওলী’ হতে হলে প্রথমে উভয় বর্ণিত বৈশিষ্ট্য পূরণ করা অবশ্য কর্তব্য বা বাধ্যতামূলক: তাঁর জন্যে মহান আল্লাহ্ পাকের হক পুরোপুরিভাবে আদায় করা অবশ্য কর্তব্য; এর পাশাপাশি সকল পরিস্থিতিতে, তা ভাল হোক বা মন্দ, আল্লাহর হেফাযত পাওয়াও তাঁর জন্যে অবশ্য কর্তব্য।” ইমাম কুশাইরী (রহ:) তাঁর ‘রেসালা’ শীর্ষক বেলায়াত-সম্পর্কিত দিকদর্শক পুস্তকে বলেন, “শরীয়তে যার সম্পর্কে আপত্তি আছে, সে ব্যক্তি বিভ্রান্তিতে পড়বে ও ধোকা খাবে।”

এসব উদ্ধৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি হলো শরীয়তের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন। মৌলিক তাসাউফ শরীয়তের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সূফী মতবাদ শরীয়তের ‘উর্ধ্বে’ মর্মে ব্যতিক্রমী কথাবার্তা যা অজ্ঞদের কাছ থেকে শোনা যায় বা পূর্ববর্তী প্রাচ্যদেশীয় তাত্ত্বিকদের মতামতে বিধৃত হয়েছে, তা ভ্রান্তি ও অনবহিত অবস্থার প্রমাণবহ। দ্বীন ইসলামের মহান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো, শরীয়ত ও এর পূর্ণ তাবেদারি এবং এতদসংক্রান্ত জ্ঞানই খোদা তা’লার সান্নিধ্য পাবার মাধ্যম। উদাহরণস্বরূপ, সালাত (নামায)-কে আমরা খোদাপ্রদত্ত চাবি ও মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করবো যা দ্বারা আমরা তাঁর সান্নিধ্যে ‘ভ্রমণ’ করতে সক্ষম।

হযরত রাসূলে আকরাম (দ:) থেকে বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন- ‘সালাত প্রত্যেক মো’মেন মুসলমানের জন্যে মে’রাজস্বরূপ।” এ হাদীসে তিনি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তুলনা দিয়েছেন তা আমাদের লক্ষ্য করা উচিৎ। এক মুহূর্তের জন্যে আমরা এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবো। সালাত হচ্ছে কোনো মো’মেন মুসলমানের জন্যে একটি মহা আধ্যাত্মিক যাত্রা; যাকে মহানবী (দ:)-এর মে’রাজ রজনীর যাত্রার সাথে তুলনা করা হয়েছে- যেখানে তিনি মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম থেকে যাত্রা শুরু করে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে আল্লাহ্ তা’লার একেবারেই কাছে চলে গিয়েছিলেন; এতো কাছে যে সেখানে ফেরেশতাবৃন্দও যেতে পারেন না। হুজুর পূর নূর (দ:)-এর এই যাত্রা ছিল তাসাউফের পথে পথিকদের চিরন্তন অন্বেষণের পূর্বসূচনা এবং এই হাদীসের মর্মানুযায়ী প্রত্যেক মো’মেন মুসলমানের জন্যেই তা অন্বেষণের বিষয় হওয়া উচিৎ। স্বাভাবিকভাবে আমাদের মতো সাধারণ নারী-পুরুষের পক্ষে শারীরিক বা আধ্যাত্মিকভাবে মহানবী (দ:)-এর মতো আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করা সম্ভব নয়। মূল বিষয়টি হলো, সালাত আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের কাছ থেকে প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে আগত একটি উপহার যার মাধ্যমে আল্লাহর অনুপম ও আশীর্বাদপুষ্ট নৈকট্য লাভ করা সম্ভব - অনেকটা মেরাজ রজনীতে মহানবী (দ:)-এর লাভ করা অভিজ্ঞতার মতোই।

গোটা শরীয়ত সম্পর্কেও একই রকম মন্তব্য করা যায়। একটি হাদীস শরীফে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ করেন, “আল্লাহ্ বলেন: আমার বান্দার জন্যে নৈকট্য অন্বেষণের সর্বোত্তম পন্থা হলো আমি যা তাঁর প্রতি ফরয (মা এফতারাদতু আলাইহে) করেছি তা নিরন্তর অনুশীলন করা।” এখানে আমরা একটি বিষয়ের প্রতি দ্রুত দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো আর তা হলো, আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে সালাত, রোযা, হজ্জ ও যাকাতই শুধু দ্বীন ইসলামের ফরায়েয (অবশ্য কর্তব্য) নয়। অন্যান্য ফরযের মধ্যে রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, নিজ স্ত্রী, সন্তান ও প্রতিবেশীদের প্রতি সদাচরণ; ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক লেন-দেনের সময় ন্যায়পরায়ণতা ও সততা; রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর হলে তাতেও ন্যায়পরায়ণতা ও সততা অবলম্বন; দ্বীনের শত্রুদের সাথে যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা; অন্তরের ও মস্তিষ্কের পবিত্রতা এবং তাতে হিংসা-বিদ্বেষ, দম্ভ ও কপটতা বা কুটিলতার অনুপস্থিতি ইত্যাদি। শরীয়ত এগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে। এ সবেরই মূলনীতি হলো, আমরা যতক্ষণ আল্লাহ্ তা’লার শরীয়তকে আমাদের জীবনে পূর্ণতা না দেবো ও বাস্তবায়ন না করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনোক্রমেই আমরা তাঁর রেযামন্দি তথা সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবো না এবং তাঁর নৈকট্য পাবো না। মুতকাদ্দিমীন তথা পূর্ববর্তী যমানার উলামায়ে হককানী আরও এক কদম বেড়ে এসব ফরযের সাথে নবী করীম (দ:)-এর সমস্ত সুন্নাহ এবং এমন কি শরীয়তের সকল আদবকেও যোগ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার বর্ণনা নিচে দেয়া হলো:

হযরত বায়েযীদ বোস্তামী (রহ:) একবার এমন কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন যাকে তাঁর পরিচিতজন ও শিষ্যরা একজন “ওলী” হিসেবে বর্ণনা করেন। যখন তিনি সেই “ওলীর” মসজিদে পৌঁছুলেন, তখন তিনি বসে গেলেন তাঁর অপেক্ষায় - ওই ব্যক্তির কাজ শেষ হওয়া না পর্যন্ত। ব্যক্তিটি মসজিদ ত্যাগের সময় বাইরে  নয়, বরং মসজিদের ভেতরে থুথু ফেল্লো। হযরত বায়েযীদ (রহ:) তাঁকে সালাম না জানিয়েই ওই স্থান ত্যাগ করেন। স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হলো, কেননা হযরত বায়েযীদ (রহ:) ছিলেন একজন বিশেষভাবে খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব যাঁর আধ্যাত্মিক মকাম ও পান্ডিত্য তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে সর্বজনবিদিত ছিল। মানুষজন এর কারণ হন্যে হয়ে জানতে চেষ্টা করলো যে, কেন এই লোককে হযরত বায়েযীদ (রহ:) অবজ্ঞা করলেন। অতঃপর তিনি উত্তর দিলেন, “শরীয়তের আদবসমূহের একটির বেলায় যদি এই ব্যক্তির ওপর আস্থা না রাখা যায়, তাহলে আল্লাহর মা’রেফতের (ভেদের রহস্যের) ক্ষেত্রে কীভাবে তার ওপর নির্ভর করা যাবে?”

আউলিয়ার প্রতি ভালবাসা

কোনো ওলী একদিকে যেমন আল্লাহ পাকের করীব বা নিকটে, তেমনি তিনি মুকাররব তথা নিকটবর্তীও। তিনি নিজ প্রচেষ্টায় শরীয়ত পালন করে আল্লাহর নিকটবর্তী হন, যার প্রতিদানে আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে সাহায্য করেন ও সুরক্ষিত রাখেন এবং তাঁর কাছে টেনে নেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান- “আল্লাহ্ বলেন: আমি আমার বান্দার চিন্তার মধ্যে রয়েছি; তিনি যদি নিজ হতে আমাকে স্মরণ করেন, আমিও তাঁকে নিজ হতে স্মরণ করবো; আর যদি তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন, তবে আমি তাঁর হাতের কাছে অগ্রসর হই; আর যদি তিনি আমার দিকে হাতের কাছে পৌঁছে যান, তাহলে আমি তাঁর বাহুর নিটকবর্তী হই; তিনি আমার দিকে হাঁটতে থাকলে আমিও তাঁর দিকে বাতাসের বেগে ধাবিত হই।” অন্য এক বর্ণনায় আছে,  “তিনি আমাকে স্মরণ করলে আমিও তাঁর সাথে থাকি।”

এ হাদীসে কুদসীটি অর্থে সমৃদ্ধ। যারা আল্লাহর বাতেনী জ্ঞানের রাস্তা তালাশ করেন এবং তাঁরই নৈকট্য চান, তাঁদের জন্যে এখানে প্রচুর উৎসাহের খোরাক রয়েছে। “আমি আমার বান্দার চিন্তার মধ্যে রয়েছি” এবং অন্যত্র বর্ণিত “বান্দা আমাকে স্মরণ করলে আমিও তাঁর সাথে থাকি”- হাদীসে কুদসীগুলো দু’টি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ আদব ব্যক্ত করে। প্রথমতঃ আমাদের এবাদত পলানকালে আল্লাহর প্রতি ’হুসনু যন্নি’ তথা নির্মল ও বিশুদ্ধ চিন্তা এবং অবিচল আস্থা নিয়ে তা আমাদের করা উচিত। বস্তুতঃ চিন্তায় বিশুদ্ধতা নিজেই একটি এবাদত। আল্লাহর প্রতি হুসনু যন্নি-র অর্থ তাঁর ইচ্ছাকে পুরোপুরিভাবে মেনে নেয়াও। এ পথের পথিকের উচিৎ কঠোর পরিশ্রম দ্বারা খোদা তা’লার প্রতি সকল প্রকার ক্ষোভ মন থেকে অপসারণ করা। আল্লাহ্ অন্যান্যদেরকে দান করেন এবং আমাদের তা দানে বিরত থাকতে পারেন।

আল্লাহ্ তা’লার ইচ্ছার প্রতি অসন্তুষ্টি এবং তাঁর প্রতি ক্রোধে ফেটে পড়াই হলো হিংসা-বিদ্বেষের মূল। দ্বিতীয়তঃ আমরা যেহেতু তাঁর হুজুরে (উপস্থিতিতে) রয়েছি এবং তিনিও আমাদের সাথে রয়েছেন, সেহেতু তাঁর প্রতি সর্বাধিক মনোযোগ দেয়ার আদব আমাদের মেনে চলতে হবে। এটি কষ্টসাধ্য হলে কিংবা এবাদতের সময় একাগ্রচিত্তে তাঁর প্রতি মনোনিবিষ্ট হওয়া সম্ভব না হলে আমাদের হয় নিজেদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, নয়তো এ প্রশিক্ষণদানে সক্ষম এমন কাউকে খুঁজে বের করার প্রয়োজন হবে। কুরবাত তথা নৈকট্যের মকাম ও বেলায়াতের মকাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে উভয় মকামই একান্তভাবে কাম্য হওয়া উচিৎ। ওপরে উদ্ধৃত হাদীসে কুদসীতে পরিস্ফুট হয় যে আমরা যে ‘গতি’ ও ‘উদ্যমে’ আল্লাহর দিকে ধাবিত হই, তিনি তার চেয়েও বেশি গতি ও উদ্যমে আমাদের কাছে আসেন।

‘হাদীসুল আউলিয়া’ খ্যাত রওয়ায়াতে তথা বিবরণে আউলিয়ায়ে কেরামের সুউচ্চ মকাম সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’লা তাঁদেরকে নিজস্ব রক্ষণাবেক্ষণে রাখেন এবং সাহায্য করেন। আউলিয়ায়ে কেরামকে যে ব্যক্তি ভালবাসে সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকেই ভালবাসে। আর এর বিপরীতে যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হয়, তার বিরুদ্ধে “আল্লাহ্ যুদ্ধ ঘোষণা করেন”; এই হাদীসে কুদসী আবু হুরায়রা (রা:) হতে ইমাম বুখারী বর্ণিত। অন্য একটি হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’লা এরশাদ ফরমান- “যে ব্যক্তি আউলিয়াকে আঘাত দেয়, সে আমার সাথে যুদ্ধ করাকে হালাল জ্ঞান করেছে” (হযরত আয়েশা রা: থেকে ইমাম আহমদ ও ইমাম কুশায়রী বর্ণিত)। ইমাম তাবারানী (রহ:) বর্ণিত এতদসংক্রান্ত রওয়ায়াতগুলোতে মূলতঃ শব্দগত পার্থক্য বিদ্যমান; তাতে আরও কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বর্ণনা যুক্ত রয়েছে যা অন্যান্যদের বর্ণনায় নেই। এসব রওয়ায়াতের পূর্ণ বিশ্লেষণ এই স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয়, তাই তা অন্য সময় ও স্থানে করার ইচ্ছা রইলো। এখানে শুধু রওয়ায়াতগুলোর উত্থাপিত কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করা জরুরি বিবেচনা করা হয়েছে।

১। এ হাদীসে কুদসী থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি আর তা হলো, আউলিয়ায়ে কেরামকে ভালবাসা অবশ্য কর্তব্য। তাঁদেরকে অপছন্দ করা বা আঘাত দেয়া নিষিদ্ধ। খোদা তা’লা কর্তৃক যুদ্ধ ঘোষণার চেয়ে বড় কোনো শাস্তি নেই। অবশ্য কর্তব্য ও নিষিদ্ধ হওয়ার উপরোক্ত বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় এতো বড় শাস্তির বিষয়টি থেকেই। কথা বা কাজে আউলিয়ায়ে কেরামকে আঘাতদানকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহ্ পাক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। অতএব, তাঁদেরকে আঘাত দেয়া নিষিদ্ধ এবং এরই ফলশ্রুতিতে তাঁদেরকে সম্মান করা ও ভালবাসা অবশ্য কর্তব্য। তাঁরা ইসলাম ধর্মের প্রকৃত রূপের প্রতিনিধিত্বকারী এবং শরীয়তের পূর্ণ প্রতিফলনকারী। আর এর প্রতিদানস্বরূপ তাঁরা আল্লাহর প্রিয়ভাজন বান্দা।

আবু তোরাব নকশাভী এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলে ধরেছেন: “যদি অন্তর আল্লাহর প্রতি শত্রুতাভাব পোষণ করে, তবে তা আউলিয়ার সমালোচনা ও তাঁদের প্রতি ঘৃণাসহ আবির্ভূত হয়েছে” (ইমাম কুশায়রী বর্ণিত)। প্রত্যেক মুসলমান যিনি আল্লাহকে ভয় পান এবং নিজ দ্বীন হেফাযতে সচেতন, তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক হবেন। কিছু কিছু গোষ্ঠীর তরফ থেকে হক্কানী-রব্বানী উলামায়ে কেরাম ও বুযূর্গানে দ্বীন এবং সর্বোপরি সাহাবায়ে কেরামের প্রতি সমালোচনা ও বৈরিতা যা আমরা শুনতে পাই তা সত্যি উদ্বেগের বিষয়।

ইমাম আবু হানিফা (রহ:), ইমান শাফেয়ী (রহ:), সাইয়্যেদুনা গাউসে আযম আবদুল কাদের জিলানী (রহ:), ইমাম গাযযালী (রহ:) এবং তাঁদের মতো অন্যান্য বুযূর্গানে দ্বীন যদি আল্লাহর আউলিয়া না হন, তাহলে কারা আউলিয়া হবেন; তাঁদের মতামতের বিজ্ঞ (আলেমানা) আলোচনা-সমালোচনা এক জিনিস, আর তাঁদেরকে হেয় করা, খাটো করা হলো ভিন্ন আরেক জিনিস। আবু তোরাবের মহানুযায়ী, এগুলো  হলো আরও গভীর ও বিপজ্জনক প্রবণতার লক্ষণ। এই ঘৃণা ও বৈরিতার কারণ সমালোচকদের অন্তরে খুঁজতে হবে এবং যাঁদেরকে তারা সমালোচনা করছে তাঁদের মাঝে এটা খোঁজার প্রয়োজন নেই।

২। এ রওয়ায়াতের আরেকটি মৌলিক বিষয এই যে, আল্লাহর নৈকট্যের মকামের রাস্তা হলো শরীয়ত: ‘মা এফতারাদতু আলাইহি’ অর্থাৎ, “আমার নৈকট্যের সর্বোত্তম পথ হলো ফরয অনুশীলন করা”; উপরন্তু, এরশাদ হয়েছে- “আমার বান্দা নফল অনুশীলন করে আমার এতো নিকটবর্তী হয় যে আমি তাকে ভালবাসি।” আল্লাহর নৈকট্যের মকাম ও বেলায়তের মকামের রাস্তা হলো ফরায়েয (ফরযসমূহ) ও নওয়াফেল (নফলসমূহ), যা বিস্তারিতভাবে শরীয়তে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অতএব, শরীয়ত হলো ওই সব শিক্ষা, তরীকত ওগুলোর অনুশীলন এবং নৈকট্য হলো মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। পথের শুরুতে রয়েছে নিজ সত্তার ওপর শরীয়ত জারি করার সংগ্রাম (মোজাহাদা), আর শেষে রয়েছে আল্লাহর নৈকট্যের মকামে উন্নীত হয়ে তাঁর মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্য দর্শন (মোশাহাদাহ্)। তাই তাসাউফের পথে অগ্রসর হতে চান এমন সবার উচিৎ শরীয়তকে শিক্ষা ও উপলব্ধি করার প্রয়োজনীয় প্রয়াস পাওয়া।

আমরা আগেই বলেছি যে সালাত (নামায), রোযা ও হজ্জ্-ই কেবল দ্বীন ইসলামের ফরয এবাদত নয়, বরং এতে আরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা যা সমভাবে গুরুত্বের দাবিদার । এ ক্ষেত্রে জানতে হলে ইমাম নববী (রহ:)-এর রিয়াযুস সালেহীন গ্রন্থটি প্রণিধানযোগ্য।

৩। নৈকট্যের মকাম (মাকামুল কুরব্) দু’ভাগে বিভক্ত: কুরব্ ফরায়েয (ফরযসমূহের নৈকট্য) ও কুরব্ নওয়াফেল (নফলসমূহের নৈকট্য)। এগুলো সম্পর্কে পরবর্তী কোনো সময়ে আলোচনা করার আশা রইলো, ইনশা-আল্লাহ!

[এ প্রবন্ধটি www.sunnah.org/tasawwuf/sainthood.htm ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত। লেখক মক্কা মোকাররমার বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন শায়খ মোহাম্মদ আলাউয়ী মালেকীর ছাত্র ও ভাবশিষ্য এবং মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদপ্রাপ্ত।]