প্রশ্ন : উকিল বাবার সাথেও কি পর্দা করা জরুরি?
উত্তর : মানবজীবনে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। পাত্র-পাত্রীর মাঝে অসামঞ্জস্যতা বিয়ে-পরবর্তী দাম্পত্য জীবনে নানা সঙ্কট সৃষ্টি করে। অনেক সময় সে সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব হয় না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান ও অসামঞ্জস্যতা অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে বিচ্ছেদেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাই ইসলাম পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে, যাতে বিয়ে করে মানুষ অতৃপ্তিতে না ভোগে এবং বিয়ের মতো একটি পবিত্র ও ধর্মীয় বন্ধন সারা জীবন অটুট থাকে। পাত্র-পাত্রীর মাঝে সামঞ্জস্যতা দাম্পত্য জীবনে এনে দেয় স্বস্তি ও প্রশান্তি। এই প্রশান্তিই নর-নারীকে সাহায্য করে যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থেকে নিজেদের চারিত্রিক পবিত্রতা অক্ষুণœ রাখতে। হাদিস শরিফে আছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, আমি এক আনসারী মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। নবী সা: বললেন, মেয়েটিকে দেখে নাও। আনসারীদের চোখে আবার সমস্যা থাকে। (মুসলিম শরিফ)
পাত্র-পাত্রী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে নানা অপসংস্কৃতি প্রচলিত আছে। অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল অপ্রতিরোধ গতিতে আমাদের সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে। অপসংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তারের ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে অপসৃত হচ্ছে ধর্ম ও সমাজের শতাব্দীর পর শতাব্দী লালিত ইসলামের মূল চেতনা। এসব অপসংস্কৃতির একটি হলো, উকিল বাবাকে নিজের বাবার মতো মনে করা। আমাদের দেশের অনেক এলাকায় দেখা যায়, বিয়ের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা সৃষ্টিকারী উকিল বাবাকে নিজের বাবার মতো মনে করা হয়। তিনি নিজে গিয়ে পাত্রী দেখে আসেন এবং তার কাছ থেকে বিয়ের অনুমতি এনে বিয়ের মজলিসে কনের পক্ষ হয়ে ওকালতি করেন। পরে তিনি কনের আপন বাবার মর্যাদায় ভূষিত হয়ে তার মাহরামদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি কনের পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের হাদিয়া-তোহফা পেয়ে থাকেন। তার সাথে পর্দা রক্ষা করা হয় না। উকিল বাবা সাধারণত কনের মাহরাম কোনো আত্মীয়স্বজন হন না। বরং তিনি গাইরে মাহরামই হয়ে থাকেন। তার সাথে পর্দা করা ইসলামের দৃষ্টিতে ফরজ। শুধু সামাজিক প্রচলনের ওপর ভিত্তি করে একজন গাইরে মাহরাম ব্যক্তিকে উকিল বাবা ঠিক করে তার সাথে মাহরাম আত্মীয়স্বজনের মতো দেখা সাক্ষাৎ করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। ইসলাম সব গাইরে মাহরামের সাথে পর্দা করার নির্দেশ দিয়েছে। পর্দা নারীর সৌন্দর্য। নারীর মান-সম্মান, ইজ্জত-আব্রু হেফাজত করার জন্যই পর্দা রক্ষা করে চলা অপরিহার্য কতর্ব্য। কুরআনে কারিমে বলা হয়েছে, মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। তারা যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত তাদের আভরণ প্রদর্শন না করে। তাদের বক্ষদেশ ও গ্রীবা যেন মাথার কাপড় দিয়ে আবৃত করে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীরা, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌনকামনা রহিত পুরুষ ও নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকট তাদের আভরণ প্রকাশ না করে। (সূরা নূর : ২৪-৩০)
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, কাউকে উকিল বাবা ঠিক করার কারণে তার সাথে পর্দার বিধান রহিত হয়ে যায় না। কাজেই উকিল বাবার সাথেও পরিপূর্ণ পর্দা করতে হবে।
অনেক সময় মেয়ের কাছ থেকে অনুমতি আনার সময় সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য উকিল বাবার সাথে বর কনে উভয় পক্ষের দুজন সাক্ষী যান। এই সাক্ষী রাখাকে জরুরিও মনে করা হয়। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। শরিয়তের দৃষ্টিতে গাইরে মাহরাম কেউ মেয়ের কাছে অনুমতি আনার জন্য তার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে পারবে না। বিয়ের আগে পাত্রীকে গাইরে মাহরামদের মধ্যে শুধু পাত্রই কিছু শর্তসাপেক্ষে দেখতে পারবে। নিচে শর্তগুলো উল্লেখ করা হলো।
১. পাত্রী দেখার সময় পাত্রের পক্ষের কোনো পুরুষ যেমন বাপ-ভাই, বন্ধু-বান্ধব প্রমুখ কেউ থাকতে পারবে না। পাত্রী দেখা তাদের জন্য সম্পূর্ণ হারাম ও কবিরা গুনাহ।
২. পাত্র-পাত্রী একে অপরের সাথে কথা বলতে পারবে। একে অপরের সম্পর্কে জানতে পারবে, জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তবে একে অপরকে স্পর্শ করতে পারবে না। অনেক এলাকায় স্পর্শ করার যে প্রচলন আছে, তা শরিয়ত অনুমোদিত নয়।
৩. পাত্রীর শুধু কব্জি পযর্ন্ত হাত, টাখনু পর্যন্ত পা ও মুখমণ্ডল দেখতে পারবে। এ ছাড়া শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ আবরণ ছাড়া দেখতে পারবে না। অনেক এলাকায় মেয়ের মাথার কাপড় ফেলে চুল দেখানোর প্রচলন আছে। সেটিও নিতান্তই ভুল।
৪. পাত্রীর কোনো মাহরাম পুরুষের উপস্থিতি ছাড়া পাত্রী দেখা জায়েজ নয়। সুতরাং নির্জনে পাত্র-পাত্রী একত্রিত হতে পারবে না।
৫. পাত্র-পাত্রী উভয়েই অপরকে প্রতারিত করার জন্য অস্বাভাবিক কোনো সাজসজ্জা করতে পারবে না। এতে প্রতারণার গুনাহ হবে। তবে শরীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য স্বাভাবিক সাজসজ্জা করতে পারবে।
প্রশ্ন : মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে মহিলাদের গাড়ি চালানো নিষেধ। কিন্তু কেন? এটা কি ঐসব দেশের নিজস্ব আইন দ্বারা বন্ধ করা হয়েছে নাকি ইসলাম ধর্মমতে মহিলাদের গাড়ি চালানো নিষেধ। যদি ইসলাম ধর্মমতে মহিলাদের গাড়ি চালানো নিষেধ হয়ে থাকে তাহলে কোরআন ও হাদিসের আলোকে এর কারণ জানতে চাই।
উত্তর : ইসলাম ধর্মে কিছু বিষয় আছে যেগুলো সরাসরি কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হয়তো বৈধ, আদিষ্ট, নতুবা নিষিদ্ধ। যেমন নামায পড়ার আদেশ আর মদ পানে নিষেধ। আবার কিছু বিষয় আছে যেগুলো সরাসরি কুরআন হাদীসে উল্লেখ করে নিষেধ করা হয়নি, কিন্তু এমন কিছু কারণ বা বিষয়ের উপস্থিতি আছে তাতে, যেগুলো পৃথকভাবে নিষিদ্ধ। ফলে সেসবের উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। নারীর গাড়ি চালানো এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। উপরোক্ত ভূমিকার সাথে আরেকটু যোগ করি, কুরআনের একটি আয়াত আছে। “তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহকে মন্দ বলবে।” (৬:১০৮)
এই আয়াতটি লক্ষ্য করুন। আল্লাহ তায়ালা তিনি ব্যতিত অন্য উপাস্যদের মন্দ বলতে নিষেধ করছেন। এর কারণ তিনি উল্লেখ করছেন এই, যে, এতে সেসব উপাস্যদের উপাসকরাও না বুঝে আল্লাহকে মন্দ বলবে।
এই আয়াত থেকে একটি মূলনীতি আমারা খুঁজে পাই। সেটি হলো, অর্থাৎ, যা করার প্রেক্ষিতে কোনো হারাম কাজ করতে হয়, সে কাজটিও হারাম হয়ে যায়। উল্লিখিত আয়াতে লক্ষ্য করুন, আল্লাহকে মন্দ বলা হারাম। কিন্তু তিনি ব্যতিত অন্য উপাস্যদের মন্দ বলা হারাম নয়। অথচ তাদের মন্দ বললে (যা বৈধ) আল্লাহকেও মন্দ বলা হয় (যা হারাম)। কাজেই তাদেরকে মন্দ বলাও হারাম হয়ে গেল।
আবার আরেকটি আয়াত দেখুন। আল্লাহ বলছেন, তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্যে উপকারিতাও রয়েছে। তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়। (২:২১৯) উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা মদ হারাম ঘোষণা করার প্রাক্কালে বলেন, মদ ও জুয়ায় কিছু উপকারিতাও আছে, আবার কিছু পাপও আছে। তবে পাপের অংশটা উপকারিতার অংশ থেকে বড়। আর উপকারিতা গ্রহণের চেয়ে পাপ বর্জন গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই মদ পরিত্যাগ করাই উচিৎ।
এ আয়াত থেকে আমরা আরেকটি মূলনীতি পাই। সেটি হলো, অর্থাৎ, অনিষ্ট দূর করা উপকারিতা অর্জনের চেয়ে অগ্রগামী।
এই দুই মূলনীতির ভিত্তিতেই শেখ আব্দুল্লাহ বিন বায ও শেখ উসাইমিন প্রমুখ নারীর জন্য গাড়ি চালানো হারাম বলেছেন। তারা দেখিয়েছেন যে, গাড়ি চালানো যদিও সরাসরি কুরআন-হাদীস দ্বারা নিষিদ্ধ নয়, তথাপি নারী যখন তা চালায়, তখন এমন কিছু বিষয় সামনে আসে, যেগুলো নিষিদ্ধ। পর্দাহীনতা, আকষ্মিক অশ্লীলতা, অনিচ্ছাকৃত আরো কিছু বিষয়, যেগুলো নিষিদ্ধ। কাজেই গাড়ি চালানোও তাদের জন্য নিষিদ্ধ। নারীর গাড়ি চালানোতে যে উপকারিতা আছে তার চেয়ে এর কারেণ সংঘটিত পাপের অংশ বড়। আর উপকারিতা অর্জনের চেয়ে পাপ বর্জন শ্রেয়। কাজেই নারীদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ। তবে তারা এও বলেছেন যে, যদি কারো একান্ত প্রয়োজন হয়, স্বামী-সন্তান বা ভাই-বাবা কেউ না থাকে, কর্মস্থলে যেতে হয় নিজে গাড়ি চালিয়ে, তাহলে সে চালাতে পারে। তদুপরি পর্দা ও মডেস্টির যথোপযুক্ত সংরক্ষণ করেই সে চালাতে পারে। ভালো থাকুন।
প্রশ্ন : আমার এক চাচাতো বোন বলেছে যে, ঘরে মাহরামের সামনে নাকি ওড়না পরতে হয় না। তার এ কথা কি ঠিক? মাহরামের সামনে কোন অঙ্গগুলো খোলা রাখা যায়
উত্তর : মাহরাম পুরুষের জন্য মহিলার মাথা, চেহারা, হাত, গলদেশ ও হাঁটুর নিচের অংশ সতর নয়। তবে তাদের সামনেও যতটুকু সম্ভব আবৃত থাকাই উত্তম। বিশিষ্ট তাবেয়ী হাসান বসরী বলেছেন, ‘নিজ ভাইয়ের সামনেও নারীর ওড়না ছাড়া থাকা উচিত নয়।’ [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৯/৩৭৩] প্রখ্যাত তাবেয়ী আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ. বলেছেন, ‘মাহরাম পুরুষের সামনে মেয়েদের মাথা ঢেকে রাখাই আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়। অবশ্য মাহরাম তা দেখে ফেললে গুনাহ হবে না।’ [প্রাগুক্ত, কিতাবুল আসল ৩/৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২৯১] প্রশ্ন: কিছু দিন আগে এক দেশে আইন করা হয় যে, মহিলারা বোরকা পরতে পারবে, তবে চেহারা ঢাকতে পারবে না। তাদেরকে মুখমন্ডল খোলা রাখতে হবে। এ বিষয়ে একজন বললেন, এতে শরীয়ত-বিরোধী কিছু নেই। কারণ মহিলাদের চেহারা ঢাকতে হবে এমন কথা কুরআন-হাদীসে নেই। তাই চেহারার পর্দা জরুরি নয়। তার এ কথা কতটুকু সত্য? দলীল-প্রমাণসহ বিস্তারিত জানতে চাই।
উত্তর : ঐ ব্যক্তির কথা ঠিক নয়। পরপুরুষের সামনে নারীকে তার চেহারা ঢেকে রাখতে হবে। এটি কুরআন-সুন্নাহর বিধান। উম্মাহাতুল মুমিনীন ও অন্যান্য সাহাবিয়ার আমল দ্বারাও তা প্রমাণিত। নিম্নে কয়েকটি দলীল উল্লেখ করা হল। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, হে নবী! আপনি বলুন, নিজের স্ত্রী-কন্যা ও মুমিনদের স্ত্রীগণকে, তারা যেন টেনে নেয় নিজেদের উপর তাদের চাদরের কিছু অংশ। [সূরা আহযাব : ৫৯] এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, আল্লাহ তাআলা মুমিনদের স্ত্রীগণকে আদেশ করেছেন, তারা যখন কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে চাদর টেনে নিজেদের চেহারা ঢেকে নেয়। এবং শুধু এক চোখ খোলা রাখে। [তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৮২৪] ইমাম জাসসাস রাহ. বলেন, এই আয়াতে যুবতী নারীদেরকে পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখার আদেশ করা হয়েছে। [আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/৩৭২, আরো দেখুন : তাফসীরে কুরতুবী ১৪/১৫৬; জামেউল বয়ান, তবারী ১০/৩৩১; তাফসীরে রূহুল মাআনী ২২/৮৮] আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. হজ্বের সফরের বিবরণ দিয়ে বলেন, আমরা ইহরাম অবস্থায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। আমাদের পাশ দিয়ে অনেক কাফেলা অতিক্রম করত। তারা আমাদের সামনে এলে নিজেদের চেহারার উপর ওড়না ঝুলিয়ে দিতাম। তারা অতিক্রম করে চলে যাওয়ার পর ওড়না সরিয়ে ফেলতাম। [সুনানে আবু দাউদ ২/৪৫৭] আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. অন্য এক সফরের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, অতপর সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল আসসুলামী সকালে আমার অবস্থানস্থলে পৌঁছল। সে একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখে আমার নিকট এল এবং আমাকে চিনে ফেলল। কেননা, পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার আগে সে আমাকে দেখেছিল। তখন সে জোরে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করল, যার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সাথে সাথে আমি ওড়না দ্বারা মুখমন্ডল আবৃত করে ফেলি। [সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৮৫০] হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, আমরা পর পুরুষের সামনে আমাদের চেহারা ঢেকে রাখতাম। [মুসতাদরাকে হাকীম ২/১০৪ আরো দেখুন : তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৮০৪; আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/৩৬৯; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩২৪, ৪৭৫৭, ১৮৩৮; ফাতহুল বারী ২/৫০৫, ৮/৩৪৭; উমদাতুল কারী ৪/৩০৫; মাআরিফুস সুনান ৬/৯৮; তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ৪/২৬৮; মাজমুআতুল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া ২২/১০৯, ১১৪] মোটকথা, কুরআন-হাদীসের ভাষ্য এটাই যে, মহিলারা পরপুরুষের সামনে নিজেদের মুখমন্ডল আবৃত রাখবে। এটা পর্দারই অংশ। প্রকাশ থাকে যে, কোনো কোনো দেশে নারীর মুখমন্ডল খোলা রাখার যে আইন করা হয়েছে তা এ কারণে করা হয়নি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে চেহারার পর্দা নেই। বরং এ আইনের পিছনে ইসলামের প্রতি তাদের অব্যাহত বিদ্বেষ এবং মুসলমানদের কোনঠাসা করার প্রবণতাও কার্যকর। এ আইন তাদেরই কথিত মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার সম্পূর্ণ বিরোধী। তাই এই আইন আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও ধিকৃত হয়েছে।
প্রশ্ন : শাশুড়ির মামার সাথে দেখা সাক্ষাত করা যাবে কি?
উত্তর: শাশুড়ির মামা মাহরাম নয়। তাই তার সাথে দেখা সাক্ষাত করা জায়েয হবে না। [সূরা নিসা : ২২-২৪; তাফসীরে কুরতুবী ৫/১০৩; তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৭১১; আলমুফাসসাল, মাদ্দাহ : ৫৪৫২] প্রশ্ন : গত কয়েক বছর পূর্বে আমরা এলাকর মহিলাদের জন্য তালীমের ব্যবস্থা করেছি। একটি আলাদা ঘরে পূর্ণ পর্দার সাথে সপ্তাহে দুই দিন শুক্রবার ও সোমবার বাদ যোহর দ্বীনি বিষয় ও মাসআলা মাসায়েল আলোচনা করা হয়। একজন মহিলা মজলিসটি পরিচালনা করেন। এতে আশপাশের মহিলারাই অংশগ্রহণ করেন। তবে পাঁচ-ছয় মাইল দূরবর্তী এলাকার স্বল্প সংখ্যক মহিলাও অভিভাবকের অনুমতিক্রমে মাহরাম ছাড়া এসে থাকেন। পাঁচ-ছয় মাইল দূর থেকে মাহরাম ছাড়া আসাকে কেন্দ্র করে এলাকার কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলেছে। অতএব হুজুরের নিকট আমার জানার বিষয় হল : প্রশ্ন : ক) পার্শ্ববর্তী ও পাঁচ-ছয় মাইল দূর থেকে পর্দার সাথে মহিলাদের মাহরাম ছাড়া আসাটা কেমন? প্রশ্ন : খ) পর্দা রক্ষা করে কোনো মহিলা নিজ বাড়িতে তালীমের ব্যবস্থা করতে পারবে কি না? প্রশ্ন : গ) মহিলাদের কাছ থেকে কোনো দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের জন্য সাহায্য গ্রহণ করা যাবে কি না?
উত্তর : ক) মহিলাদের শিক্ষার ব্যবস্থা প্রধানত নিজ ঘরেই হওয়া চাই। তারা মাহরাম পুরুষ যথা বাপ, দাদা, আপন ভাই, চাচা, মামার কাছে দ্বীন শিক্ষা করবে। হ্যাঁ, মাহরামদের মধ্যে যোগ্য আলেম না পাওয়া গেলে নিজ মহল্লার কোনো দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত দ্বীনদার মহিলার নিকট গিয়ে দ্বীন শিক্ষা করবে। তবে শর্ত হল, স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে পূর্ণ শরয়ী পর্দার সাথে আসা যাওয়া করবে এবং সন্ধ্যার পূর্বেই ঘরে পৌঁছে যাবে। তাই প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে মহল্লার মহিলারা উক্ত তালীমের মজলিসে আসতে পারেন। তবে পাঁচ-ছয় মাইল দূর থেকে এভাবে তালীমে আসা সমীচীন নয়; তারা নিজেদের মহল্লায় তালীমের ব্যবস্থা করবেন এবং ঘরে বসে দ্বীনী কিতাবপত্র পাঠ করবেন। [সূরা আহযাব : ৩৩; আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/৩৬০] খ) প্রত্যেক নর-নারীর প্রয়োজনীয় দ্বীন শিক্ষা করা ফরয। আর পূর্ণ পর্দার সাথে অভিজ্ঞ শিক্ষিকা দ্বারা দ্বীনী শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রশংসণীয় ও ছওয়াবের কাজ। মহিলাদের জন্য দ্বীনী তালীমের ব্যবস্থা করেছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। হাদীস শরীফে আছে, একদিন মহিলা সাহাবীগণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আরয করলেন, পুরুষদের কারণে আমরা আপনার নিকটবর্তী হতে পারি না। তাই আপনি আমাদের জন্য আলাদা একটি দিন নির্ধারণ করুন। তিনি তাদের জন্য বিশেষভাবে এক দিনের ওয়াদা করলেন এবং বললেন, তোমরা অমুক দিন অমুকের বাড়িতে একত্র হও। এরপর তিনি সেদিন তাদের কাছে গিয়ে ওয়াজ করলেন। [সহীহ বুখারী ১/২০; উমদাতুল কারী ২/১২৩] গ) হ্যাঁ, মহিলারা দান করলে তা গ্রহণ করা যাবে। তবে স্বামীর সম্পদ থেকে তার অনুমতি ছাড়া দান করলে সেক্ষেত্রে স্ত্রীর জন্য কেবল ঐ পরিমাণ দান করা জায়েয যা সাধারণত স্ত্রী হিসাবে স্বামীর সম্পদ থেকে দেওয়ার অনুমতি থাকে। সাধারণ নিয়ম ও পরিমাণের চেয়ে বেশি দেওয়া বৈধ হবে না। [সহীহ বুখারী ১/২০; উমদাতুল কারী ২/১২৪; আহকামুন নিসা ৫/১৬৫; আলবাহরুর রায়েক ৮/৯৩; শরহু মাআনিল আছার ২/৩৭৪; ইলাউস সুনান ১৬/১৩৩] প্রশ্ন : আমি একজন অবিবাহিতা মেয়ে। আমার বয়স আঠারো। আমি এ বছর হজ্ব করতে চাচ্ছি। আমি কি আমার খালা, খালুর সঙ্গে হজ্বে যেতে পারব? দয়া করে জানিয়ে বাধিত করবেন।
উত্তর : মহিলাদের জন্য মাহরাম পুরুষ ছাড়া সফর করাও নাজায়েয। এ ব্যাপারে সরাসরি হাদীসে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মহিলা যেন মাহরাম পুরুষ ছাড়া হজ্বের উদ্দেশ্যে না যায়।’ সুতরাং খালু যেহেতু মাহরাম নয়, তাই খালা সঙ্গে থাকলেও তাদের সাথে হজ্বে যাওয়া জায়েয হবে না। পরবর্তীতে কোনো মাহরামের সাথেই যেতে হবে। [সহীহ মুসলিম ১/৪৩২; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৯৪; হেদায়া ১/২৩৩; ফাতহুল কাদীর ২/৩৩০; বাদায়েউস সানায়ে ২/২৯৯; আলবাহরুর রায়েক ৩/৫৫১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১৮; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২৮৩] প্রশ্ন : গায়রে মাহরাম মহিলার ঝুটা খাওয়া পুরুষের জন্য জায়েয কি না? এর হুকুম কী? তদ্রূপ পুরুষের ঝুটা গায়রে মাহরাম মহিলার খাওয়ার হুকুম কী?
উত্তর : গায়রে মাহরাম পুরুষ বা মহিলার ঝুটাও পাক। তবে কেউ গায়রে মাহরামের অবশিষ্ট খাবার বা পানীয় গ্রহণে স্বাদ বা আকর্ষণ বোধ করলে তার জন্য মাকরূহ হবে। আর আকর্ষণ না হলে, স্বাদ নেওয়ার উদ্দেশ্য না থাকলে মাকরূহ হবে না। [ফাতাওয়া খানিয়া ১/১৮; আদ্দুররুল মুখতার ১/২২২; আলবাহরুর রায়েক ১/১২৬; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাদ্দুর ১/১২১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৩] প্রশ্ন : হাদীসে যে ‘দৈয়জ’ শব্দ এসেছে এর অর্থ কী? ‘দৈয়জ’ সম্পর্কে হাদীসে কী বলা হয়েছে? বিস্তারিত জানাবেন বলে আশা করি।
উত্তর : হাদীস শরীফের ঐ শব্দটি হল দাইয়ূছ। এর অর্থ হল, এমন স্বামী যে স্ত্রী বা পরিবারের কোনো মহিলাকে পাপাচার, ব্যভিচার করতে বাধা দেয় না। এককথায় বলা যায়, অসতী স্ত্রী বা নারীর আত্মমর্যাদাহীন নির্বিকার স্বামী বা অভিভাবক। এ সম্পর্কিত একটি হাদীস হল, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিন ব্যক্তির উপর আল্লাহ তাআলা জান্নাতকে হারাম করেছেন : ১। মদে অভ্যস্ত ব্যক্তি ২। পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান এবং ৩। দাইয়ূছ- যে তার পরিবার বা স্ত্রীর পাপাচারকে সমর্থন করে। [মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৫৩৭২; বুলূগুল আমানী ৩/৩৫৫৬ হাদীস : ৯৯৭৫; মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার ২/২২২; আদ্দুররুল মুখতার ৪/৭০] প্রশ্ন : ঘরবাড়িতে মহিলারা যখন নামায পড়ে তখন সেখানে অধিকাংশ সময় মাহরাম আত্মীয় স্বজন ছাড়া অন্য কেউ থাকে না। তখনও কি তাদের উপর পুরো শরীর ঢেকে নামায পড়া জরুরি?
উত্তর : মহিলাদের চেহারা, কব্জি পর্যন্ত দুই হাত ও গিরা পর্যন্ত দুই পা ব্যতীত অবশিষ্ট সম্পূর্ণ শরীর নামাযে সর্বাবস্থায় ঢেকে রাখা জরুরি। এটা নামায অবস্থার সতর। একা ঘরে নামায পড়লেও এভাবে ঢেকে নামায পড়তে হবে। আর উভয় পা খোলা রাখা জায়েয, কিন্তু তাও ঢেকে রাখা উত্তম। [আলমুহীতুল বুরহানী ২/১৪; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১/৪১৪; আদ্দুররুল মুখতার ১/৪০৪; ইলাউস সুনান ২/১৬৩; বাদায়েউস সানায়ে ১/৩০৬; মাজমাউল আনহুর ১/১২২; আলবাহরুর রায়েক ১/২৬৯; শরহুল মুনইয়াহ পৃ. ২১০] গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান