NOTICE:- ------------------ ----------------- ---------------------------

লা-মাযহাবী সালাফীরা ৮ রাকায়াত তারাবীহর কথা বলে থাকে

লা-মাযহাবী সালাফীরা ৮ রাকায়াত তারাবীহর কথা বলে থাকে। অথচ তাদের এ বক্তব্যের পিছনে কোন দুর্বল দলীলও নেই। আসুন আমরা লা-মাযহাবীদের কথিত ৮ রাকায়াত তারাবীহের পক্ষে মনগড়া দলিলসমূহ খন্ডন করি :
সালাফীদের প্রথম দলিল :
عن أبي سلمة بن عبد الرحمن أنه أخبره : أنه سأل عائشة رضي الله عنها كيف كانت صلاة رسول الله صلى الله عليه و سلم في رمضان ؟ فقالت ما كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يزيد في رمضان ولا في غيره على إحدى عشرة ركعة يصلي أربعا فلا تسل عن حسنهن وطولهن ثم يصلي أربعا فلا تسل عن حسنهن وطولهن ثم يصلي ثلاثا . قالت عائشة فقلت يارسول الله أتنام قبل أن توتر ؟ . فقال يا عائشة إن عيني تنامان ولا ينام قلبي (صحيح البخارى- أبواب التهجد، باب قيام النبي صلى الله عليه و سلم بالليل في رمضان وغي
অর্থ: হযরত আবু সালমা বিন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত তিনি হযরক আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার কাছে জানতে চান নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায কেমন হত রামাযান মাসে? তিনি বললেন-রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান ও রামাযান ছাড়া ১১ রাকাত থেকে বাড়াতেন না। তিনি ৪ রাকাত পড়তেন তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জানতে চেওনা। তারপর পড়তেন ৪ রাকাত তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা বিষয়ে জানতে চেওনা, তারপর পড়তেন ৩ রাকাত। হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন-তখন আমি বললাম-হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতর পড়ার পূর্বে শুয়ে যান? তিনি বললেন-হে আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা ! নিশ্চয় আমার দু’চোখ ঘুমায় আমার কলব ঘুমায়না।
দলীল-
√ সহীহ বুখারী-১ম খন্ড ১৫৪ পৃষ্ঠা- তাহাজ্জুদ অধ্যায়।
আসুন আমরা লা-মাযহাবীদের উক্ত দলীলের স্বরূপ উন্মোচন করি-
(১)এই হাদিসে ইযতিরাব তথা অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা থাকায় এ দিয়ে দলিল দেয়া ঠিক নয়। আল্লামা কুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন-আমি হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর এই বর্ণনাটি অনেক আহলে ইলমদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছি অনেকেই এতে অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা আছে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
দলীল-
√ ফাতহুল বারী শরুহুল বুখারী-৩য় খন্ড ১৭ পৃষ্ঠা।
(২) মূলত এই হাদিসটি তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে সংশ্লিষ্ট। এতে তারাবীহের কথা বর্ণিত নয়। নিম্নে এ ব্যাপারে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করা হল।
“হাদিসে মূলত তাহাজ্জুদের বর্ণনা এসেছে” একথার দলিল-
১. হাদিসের শব্দ ما كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يزيد في رمضان ولا في غيره
অর্থ- হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু অলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান ও রামাযান ছাড়া অন্য সময় বাড়াননা।"
এটাই বুঝাচ্ছে যে, প্রশ্নটি করা হয়েছিল রামাযান ছাড়া অন্য সময়ে যে নামায নবীজী পড়তেন তা রামযানে বাড়িয়ে দিতেন কিনা? এই প্রশ্নটি এজন্য করা হয়েছে যেহেতো বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানে আগের তুলনায় অনেক নামায পড়তেন ও ইবাদত করতেন, তাই এই প্রশ্নটি করাটা ছিল স্বাভাবিক। আর রামযান ছাড়া কি তারাবীহ আছে? যে রামাযানের আগেই তারাবীহ আর বিতর মিলিয়ে ১৩ রাকাত নবীজী পড়তেন? নাকি ওটা তাহাজ্জুদ? তাহাজ্জুদ হওয়াটাই কি সঙ্গত নয়? সুতরাং এটাই স্পষ্ট বুঝা যায় তারাবীহ নয় প্রশ্ন করা হয়েছে তাহাজ্জুদ নিয়ে যে, নবীজী তাহাজ্জুদের নামায রামাযান ছাড়া যে ক’রাকাত পড়তেন তা থেকে রামাযানে বাড়িয়ে পড়তেন কিনা? এর জবাবে হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা বললেন-১৩ রাকাত থেকে বাড়াতেননা তাহাজ্জুদ নামায।
২. এই হাদিসের শেষাংশে এই শব্দ আছে যে قالت عائشة فقلت يارسول الله أتنام قبل أن توتر ؟
অর্থ: তারপর হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা বললেন-হে আল্লাহ পাক উনার রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম !আপনি কি বিতর পড়ার আগে ঘুমান?"
এই বিষয়টি তারাবীহ এর ক্ষেত্রে কল্পনাতীত যে নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবীহ নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন আর সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুগন বিতর পড়ার জন্য হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য অপেক্ষমাণ থাকেন। বরং এটি তাহাজ্জুদ এর ক্ষেত্রে হওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত নয়কি?
৩. মুহাদ্দিসীনে কিরাম এই হাদিসকে তারাবীহ এর অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি। বরং তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুহাম্মদ বিন নসর মারওয়াজী তার কিতাব “কিয়ামুল লাইল” এর “عدد الركعات التى يقوم بها الامام للناس فى رمضان”(রামযানে ইমাম কত রাকাত তারাবীহ পড়বে) অধ্যায়ে অনেক হাদিস আনলেও হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত এই হাদিসটি সহীহ হওয়া সত্বেও তিনি আনেননি। সাথে এদিকে কোন ইশারাও করেননি।
৪. মুহাদ্দিসীনে কিরাম এই হাদিসকে তারাবীহ এর রাকাত সংখ্যার অধ্যায়ের পরিবর্তে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তার প্রণিত বুখারী শরীফে এই হাদিসটি নিম্ন বর্ণিত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন-
(ক) বিতর অধ্যায়-(১/১৩৫)
(খ) নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রাতে (নামাযের উদ্দেশ্যে) দান্ডয়মানতা রামযানে ও রামযান ছাড়া-(১/১৫৪)
(গ) রামযানে (নামাযের উদ্দেশ্যে) দান্ডয়মানতার ফযীলত অধ্যায়-(১/২৬৯)
(ঘ) নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দু’চোখ ঘুমায় অন্তর ঘুমায়না-(১/৫০৩)
প্রথম অধ্যায়ে বিতরের রাকাত সংখ্যা আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাহাজ্জুদ রামাযানে বেশি পড়তেন কিনা তা জানা আর তৃতীয় অধ্যায়ে রামাযানে বেশি বেশি নামাযের ফযীলত আর চতুর্থ অধ্যায়ে নবীজী ঘুমালে যে তার অযু ভাঙ্গেনা তার কারণ বর্ণনা জন্য হাদিস আনা হয়েছে। তারাবীহের রাকাত সংখ্যা বুঝানোর জন্য কোথায় এসেছে এই হাদিস???
৫. আল্লামা হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী এই হাদিসের ব্যাক্ষায় বলেন-আর আমার কাছে এটি প্রকাশিত হয়েছে যে, ১১ রাকাতের থেকে না বাড়ানোর রহস্য এটি যে, নিশ্চয় তাহাজ্জুদ ও বিতরের নামায রাতের নামাযের সাথে খাস। আর দিনের ফরয যোহর ৪ রাকাত আর আসর সেটাও ৪ রাকাত আর মাগরীব হল ৩ রাকাত যা দিনের বিতর। সুতরাং সাযুজ্যতা হল-রাতের নামায দিনের নামাযরের মতই সংখ্যার দিক থেকে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে। আর ১৩ রাকাতের ক্ষেত্রে সাযুজ্যতা হল-ফযরের নামায মিলানোর মাধ্যমে কেননা এটি দিনের নামাযই তার পরবর্তী নামাযের জন্য।
দলীল-
ফাতহুল বারী শরহুল বুখারী-৩/১৭
সালাফীদের দ্বিতীয় দলিল :
عن جابر بن عبد الله قال : صلى بنا رسول الله صلى الله عليه و سلم في رمضان ثمان ركعات والوتر فلما كان من القابلة اجتمعنا في المسجد ورجونا أن يخرج إلينا فلم نزل في المسجد حتى أصبحنا فدخلنا على رسول الله صلى الله عليه و سلم فقلنا له : يا رسول الله رجونا أن تخرج إلينا فتصل بنا فقال : كرهت أن يكتب عليكم الوتر (قيام الليل-90)
অর্থ: হযরত জাবের রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- হযরত রাসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সাথে রামযানে ৮ রাকাত নামায ও বিতর নামায পড়লেন, তারপর যখন পরদিন হল আমরা মসজিদে একত্রিত হলাম এবং আকাংখা করলাম নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কাছে আসবেন। আমরা মসজিদে অবস্থান করতে লাগলাম। প্রভাত হয়ে গেল। তখন আমরা গেলাম নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে। উনাকে বললাম-হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আকাংখী ছিলাম আপনি আমাদের কাছে যাবেন এবং আমাদের নিয়ে নামায পড়বেন, তখন তিনি বললেন-আমি এটি পছন্দ করছিলামনা যে, তোমাদের উপর বিতর ফরয হয়ে যাক।
দলীল-
√কিয়ামুল লাইল-৯০
উক্ত দলীলের জবাব :
এই হাদিসটি নিয়ে কথিত আহলে হাদিসরা সবচে’ বেশি খুশি হতে দেখা যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল এই হাদিসটি দুর্বল। শুধু একজন নয় এই হাদিসের তিনজন রাবীর ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসীনে কিরাম বলেছেন তারা গ্রহণযোগ্য নয়। দেখুন মুহাদ্দিসীনে কিরাম কি বলে এই হাদিসের বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে।
"ইবনে হুমাইদ রাজী "
১. হাফেজ জাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন-তিনি দুর্বল
২. ইয়াকুব বিন শি’বা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-তিনি অনেক অগ্রহণীয় হাদিস বর্ণনা করেন।
৩. ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-এতে আপত্তি আছে।
৪. আবু জুরআ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-তিনি মিথ্যাবাদী।
৫. ইসহাক কু’সজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি মিথ্যাবাদী।
৬. সালেহ জাযরাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-প্রত্যেক বিষয়ে সে হাদিস বর্ণনা করে। আল্লাহর উপর অধিক অপবাদ আরোপকারী আমি তাকে ছাড়া কাউকে দেখিনি। সে লোকদের হাদিস পরিবর্তন করে ফেলে।
৭. আল্লামা ইবনে খারাশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-আল্লাহর কসম সে মিথ্যাবাদী
৮. ইমাম নাসায়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-সে গ্রহণযোগ্য নয়।
দলীল-
√মিযানুল ই’তিদাল-৩/৪৯-৫০
"ইয়াকুব বিন আব্দুল্লাহ আশআরী"
ইমাম দারা কুতনী রহঃ বলেন-সে শক্তিশালী নয়
দলীল-
√ মিযানুল ই’তিদাল-৩/৩২৪
"ঈসা বিন জারিয়া"
১. আল্লামা ইয়াহইয়া বিন মায়ীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-তার কাছে অগ্রহণীয় হাদিস আছে।
২. ইমাম নাসায়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-তার হাদিস অগ্রহণীয়।
৩. ইমাম নাসায়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-তার হাদিস পরিত্যাজ্য।
৪. আবু দাউদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-তার হাদিস অগ্রহণীয়।
৫. আল্লামা জাহাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-তিনি দুর্বলদের মাঝে শামীল
দলীল-
√ মিযানুল ই’তিদাল-২/৩১১।
এছাড়া এ হাদিসটি “বুলুগুল মারাম” কিতাবে হযরত জাবের রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকেই বর্ণিত কিন্তু সেখানে রাকাত সংখ্যার কথা উল্লেখ নেই।
দলীল-
√ বুলুগুল মারাম-৪২-৪৩
এছাড়াও এ হাদিসে আরেকটি সমস্যা আছে, তাহল-এই হাদিসে বিতর ফরয হবার আশংকার কথা বলা হয়েছে অথচ অন্য সহীহ হাদিসে তারাবীহ ফরয হয়ে যাবার আশংকা উল্লেখে করা হয়েছে।
দলীল-
√ মিযানুল ই’তিদাল-২/৪২-৪৩
প্রিয় পাঠক/পাঠিকাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম এই হাদিস দিয়ে হুকুম প্রমাণিত করার ভার। এরকম দুর্বল হাদিস দিয়ে এরকম মতবিরোধপূর্ণ বিষয় কি প্রমাণিত হয়?
সালাফীদের তৃতীয় দলিল :
و حدثني عن مالك عن محمد بن يوسف عن السائب بن يزيد أنه قال أمر عمر بن الخطاب أبي بن كعب وتميما الداري أن يقوما للناس بإحدى عشرة ركعة ( موطأ مالك-98)
অর্থ: মুহাম্মদ বিন ইউসুফ সায়েব বিন ইয়াজীদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয় হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওবাই বিন কাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও তামীমে দারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে মানুষের সাথে ১১ রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
দলীল-
√ মুয়াত্তা মালিক-৯৮।
উক্ত দলীলের জবাব :
এই হাদিস দিয়েও দলিল দেয়া ঠিক নয়। কারণ-
১. হাদিসটির শব্দে পরস্পর বিরোধীতা রয়েছে। যেমন এই হাদিসের সূত্রের একজন বর্ণনাকারী মুহাম্মদ বিন ইউসুফ তার সাগরীদ ৫ জন। তার মধ্যে ৩জন ১১ রাকাত আর ১জন ১৩ রাকাত ও ১জন ২১ রাকাতের বর্ণনা নকল করেন। এছাড়া যারা ১১রাকাতের কথা বর্ণনা তাদের বর্ণনার শব্দেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। যথা-
ক. ইমাম মালিক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এনেছেন ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনি ওবাই বিন কাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও তামীমে দারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে মানুষের সাথ ১১ রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
খ. হযরত ইয়াহইয়া আল কাত্তান বর্ণনা করেন-ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওবাই বিন কাব ও তামিমে দারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমাকে এর কাছে লোকদের একত্র করেন আর তারা দু’জন ১১ রাকাত নামায পড়াতেন।
গ. আব্দুল আজীজ বিন মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার বর্ণনায় এসেছে-আমরা হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর আমলে ১১ রাকাত নামায পড়তাম।
বর্ণনাকারীর বর্ণনার ঠিক নেই, সাথে সাথে যারা এক কথা বলেছেন তাদের বক্তব্যটিও পরস্পর বিরোধী এমন বর্ণনা পরিত্যাজ্য।
দলীল-
√ ইলাউস সুনান-৭/৪৮
২. এই বর্ণনাটি হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরেকটি সহীহ ও শক্তিশালী বর্ণনার বিপরিত। হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ২০ রাকাত তারাবীহের কথা ইমাম মালিক রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার মুয়াত্তার ৪০ নং পৃষ্ঠায় ও হাফেজ ইবনে হাজার ফাতহুল বারীর ৪ নং খন্ডের ২১৯ নং পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন। সুতরাং বুঝা গেল এই বর্ণনাটি আমলযোগ্য নয়।
৩. ইমাম মালিক রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজেই এই বর্ণনাটি আমলযোগ্য মনে করেননি, তাই তিনি নিজে ৮ রাকাতের কথা বলেননা।
৪. যদি হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ১১ রাকাতের বর্ণনাটি সহীহ হত তাহলে পরবর্তীতে হযরত উসমান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে এরকম বর্ণনা ও আমল প্রমাণিত হত, অথচ তাদের থেকে এরকম বর্ণনা প্রমাণিত নয়।
এসব কারনে উক্ত হাদীস শরীফও তারাবীর নামাজের দলীল ৮ রাকায়াত গ্রহনযোগ্য নয়।
অবশেষে একটি মজার বিষয়। লা-মাযহাবীরা ৮ রাকায়াত তারাবীহ সুন্নত মনে করে এবং তারা বিতর নামাজও পড়ে ১ রাকায়াত। যদি তাই হয়, ৮+১=৯ রাকায়াত হয়। কিন্তু তাদের ভাষ্যমতে বিতর সর মোট নামাজ ১১ রাকায়াত। তাহলে বাকি ২ রাকায়াত নামাজ কই গেলো ????

মুহাম্মাদ (সঃ) এর এলমে গায়েব সমর্থনে দলিল সমূহ

দলিল নং ১
ইমাম কাজী ইউসুফ নাবহানী (রহ:) বলেন: প্রথমত আপনাদের জানতে হবে যে এলমে গায়ব তথা অদৃশ্য জ্ঞান মহান আল্লাহর অধিকারে; আর মহানবী (দ:) বা অন্যান্যদের মোবারক জিহ্বায় এর আবির্ভাব ঘটে থাকে তাঁরই তরফ থেকে হয় ওহী (ঐশী বাণী) মারফত, নয়তো এলহাম (ঐশী প্রত্যাদেশ) দ্বারা। হুযূর পূর নূর (দ:) একটি হাদীসে এরশাদ ফরমান,
আমি আল্লাহর নামে কসম করছি, নিশ্চয় আমি কিছুই জানি না কেবল আমার প্রভু যা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া।
নোট
  • তাবুকের যুদ্ধের সময় যখন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর উট হারিয়ে গিয়েছিল, তখন তিনি মানুষদের কাছে ওর খোঁজ জানতে চান, যার প্রেক্ষিতে জনৈক মোনাফেক (যায়দ ইবনে আল-লাসিত আল-কায়নুকাঈ) বলেছিল,
এই হলেন মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যাঁর কাছে ওহী এসেছে আসমান থেকে, অথচ তিনি জানেন না তাঁর উট কোথায়।
এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে নূরনবী (দ:) আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন,
অমুক লোক (মোনাফেক) এ কথা বলেছে। নিশ্চয় আমি কিছুই জানি না শুধু আমার প্রভু খোদাতা’লা যা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া। আর তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে ওই উট অমুক উপত্যকায় একটি গাছের সাথে লাগাম জড়িয়ে গিয়ে আটকে আছে।
মানুষেরা তখনি ওখানে দৌড়ে গিয়ে (ঐ অবস্থায়) উটটিকে পায়।
  • এই বর্ণনা দু’জন সাহাবী হযরত মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রা:) ও হযরত উমারা ইবনে হাযেম (রা:) কর্তৃক প্রদত্ত এবং ‘আল-মাগাযী’ পুস্তকে ইবনে এসহাক কর্তৃক লিপিবদ্ধ বলে ইবনে হিশাম তাঁর ’সীরাহ’ (৫:২০৩) ও আত-তাবারী তাঁর ‘তারিখ’ (২:১৮৪) গ্রন্থগুলোতে বিবৃত করেছেন;
  • এ ছাড়া ইবনে হাযম নিজ ’আল-মুহাল্লা’ (১১:২২২) কেতাবে এবং ইবনে হাজর তাঁর ‘ফাতহুল বারী’ (১৩:৩৬৪, ১৯৫৯ সংস্করণ) ও ‘আল-ইসাবা’ (২:৬১৯) গ্রন্থগুলোতে, আর ইবনে হিব্বান সনদ ছাড়া স্বরচিত ‘আল-সিকাত‘ (২:৯৩) পুস্তকে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেন।
  • উপরন্তু, ইবনে কুতায়বা (রা:)-কে উদ্ধৃত করে ‘দালাইল আন্ নবুওয়াহ’ (১৩৭ পৃষ্ঠা) কেতাবে আল-তায়মী এটি বর্ণনা করেন।
  • ইমাম নাবহানীর উদ্ধৃত অংশটি হযরত উকবা ইবনে আমির (রা:) হতে আবু আল-শায়খ তাঁর ‘আল-আ’যামা’ (৪:১৪৬৮-১৪৬৯ #৯৬৭১৪) পুস্তকে বর্ণনা করেন, যা একটি দীর্ঘতর বর্ণনার অংশ এবং যা’তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নিম্নের কথাগুলো:
তুমি এখানে আমাকে কী জিজ্ঞেস করতে এসেছ তা তোমার বলার আগেই আমি বলতে পারি; আর যদি তুমি চাও, তবে তুমি আগে জিজ্ঞেস করতে পারো, আমি এরপর উত্তর দেবো.......তুমি এখানে এসেছ আমাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে।
  • মহানবী (দ:)-এর উট একইভাবে হোদায়বিয়ার অভিযানেও হারিয়েছিল এবং পাওয়া গিয়েছিল । অতএব, আমাদের কাছে তাঁর কাছ থেকে যা কিছু অদৃশ্য জ্ঞান হিসেবে এসেছে, তার সবই হলো ঐশী প্রত্যাদেশ যা তাঁর নবুয়্যতের সত্যতার একটি প্রামাণ্য দলিল।


দলিল নং ২
আরেক কথায়, ইমাম আহমদ রেযা খানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মহানবী (দ:)-এর এলমে গায়ব হচ্ছে আংশিক (’জুয’ই), অসম্পূর্ণ (গায়র এহাতী), মন্ঞ্জুরীকৃত (আতায়ী), এবং স্বকীয় নয় (গায়র এসতেকলালী), যা কুরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে নিচে:
অদৃশ্যের জ্ঞাতা, সুতরাং আপন অদৃশ্যের ওপর কাউকে ক্ষমতাবান করেন না আপন মনোনীত রাসূলগণ ছাড়া
— সূরা জিন, ২৬-২৭ আয়াত
ইমাম নাবহানী (রহ:) বলেন:
মো’জেযাগুলোর অধিক সংখ্যার কারণে এই অধ্যায়ে সবগুলো তালিকাবদ্ধ করা অসম্ভব; আর বাস্তবতা হলো এই যে এগুলোর সবই তাঁর মোবারক হাতে সংঘটিত হয়েছে, তাঁর অধিকাংশ হালতে (অবস্থায়), কেউ তাঁকে প্রশ্ন করুক বা না-ই করুক, (কিংবা) পরিস্থিতি যা-ই দাবি করেছিল (তার পরিপ্রেক্ষিতে)। এগুলো তাঁর হতবাক করা সর্বাধিক সংখ্যক মো’জেযা (অলৌকিকত্ব)।
ইমাম কাজী আয়ায (রহ:) নিজ ’আশ-শেফা’ গ্রন্থে বলেন:
মহানবী (দ:)-এর এলমে গায়ব (অদৃশ্য জ্ঞান) এই সকল মো’জেযার অন্তর্ভুক্ত যা স্পষ্ট ও নিশ্চিতভাবে আমাদের জ্ঞাত হয়েছে বিপুল সংখ্যক বর্ণনাকারীর সাদৃশ্যপূর্ণ অসংখ্য বর্ণনার মানে দ্বারা।
নোট
  • ইমাম কাজী আয়ায কৃত ‘শেফা শরীফ’ (৪১৩-৪১৪ পৃষ্ঠা): “.....গায়বের সাথে তাঁর পরিচয়ের প্রতি নির্দেশক সাদৃশ্যপূর্ণ মানে’সমূহ।”


দলিল নং ৩
ঈমানদার ও অবিশ্বাসীদের মাঝে গায়েবি এলমের সাথে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পরিচিতি ও তা জানার বিষয়টি এমনই সর্বজনবিদিত এবং সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল যে তাঁরা একে অপরকে বলতেন,
চুপ! আল্লাহর শপথ, তাঁকে জানানোর জন্যে যদি আমাদের মধ্যে কেউ না-ও থাকে, তবুও পাথর ও নুড়ি-ই তাঁকে তা জানিয়ে দেবে।
নোট
  • মক্কা বিজয়ের সময় নবী পাক (দ:) ও হযরত বেলাল (রা:) কাবা শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর ‘আত্তাব ইবনে উসায়দ এবং হারিস ইবনে হিশামকে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এ কথা বলেন।
  • এই বর্ণনা আল-কিলাঈ নিজ ‘একতেফা’ (২:২৩০) পুস্তকে উদ্ধৃত করেন।
  • আল-মাওয়ার্দী তাঁর ‘আলম আল-নবুওয়া’ (১৬৫ পৃষ্ঠা) কেতাবেও এটি বর্ণনা করেছেন।


দলিল নং ৪
আল-বুখারী (রহ:) হযরত ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
আমরা আমাদের স্ত্রীদের সাথে কথাবার্তা ও অবকাশকালীন আলাপ থেকে দূরে থাকতাম পাছে আমাদের ব্যাপারে কোনো ওহী নাযেল না হয়ে যায় (এই আশংকায়)। হুযূর পাক (দ:) বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলন)-প্রাপ্ত হবার পর আমরা আরও খোলাখুলি আলাপ করতাম।
নোট
  • হযরত ইবনে উমর (রা:) হতে গ্রহণ করে আল-বুখারী (রহ:), ইবনে মাজাহ (রহ:) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) এটি বর্ণনা করেন।


দলিল নং ৫
  • সাহল ইবনে সায়াদ আল-সাঈদী থেকে আল-বায়হাকী বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি যে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের স্ত্রীর সাথে একই চাদরের নিচে শুয়ে থাকা সত্ত্বেও কোনো কিছু করা থেকে বিরত ছিলেন এই ভয়ে যে তাঁদের সম্পর্কে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হতে পারে।
নোট
  • তাবারানী নিজ ’আল-কবীর’ গ্রন্থে (৬:১৯৬ #৫৯৮৫) এটা বর্ণনা করেন;
  • সহীহ সনদে ইমাম হায়তামীও বর্ণনা করেন (১০:২৮৪)


দলিল নং ৬
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা:) বলেন:
আমাদের মাঝে আছেন আল্লাহর নবী, যিনি কেতাব তেলাওয়াতরত,
যেমন উজ্জ্বল প্রভা ভোরের আকাশকে করে থাকে আলোকিত,
তিনি আমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন অন্ধত্ব থেকে করে মুক্ত,
আর তাই আমাদের অন্তর নিশ্চিত জানে তিনি যা বলেন তা ঘটবে সত্য ।।
নোট
  • হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হতে ইমাম বুখারী (রহ:) এটি বর্ণনা করেন তাঁর ‘আল-তারিখ আল-সগীর’ (১:২৩) কেতাবে এবং আত-তাবারানী নিজ ‘আল-আহাদ আল-মাসানী’ (৪:৩৮) গ্রন্থে।
  • আল-কুরতুবী (১৪:১০০) ও ইবনে কাসির (৩:৪৬০) তাঁদের তাফসীর কেতাবগুলোতে এই বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন।


দলিল নং ৭
আর হযরত হাসান ইবনে সাবেত (রা:) বলেন:
এক নবী যিনি তাঁর চারপাশে প্রত্যক্ষ করেন যা অন্যরা দেখতে পায় না,
প্রতিটি সমাবেশে যিনি আল্লাহর কেতাব করেন বর্ণনা,
তিনি যদি আগাম বলেন অনাগত কোনো দিনের ঘটনা,
তবে তা সত্য হবে পরদিন নয়তো তারও পরের দিন, সন্দেহ বিনা ।।
নোট
  • হিশাম ইবনে হুবাইশ থেকে গ্রহণ করে এটি বর্ণনা করেছেন আত-তাবারানী নিজ ‘আল-কবীর’ (৪:৪৮-৫০) গ্রন্থে;
  • নিজের সনদকে সহীহ ঘোষণা করে আল-হাকিম (৩:৯-১০);
  • ইবনে আবদ আল-বারর তাঁর ’আল-এসতিয়াব’ (৪:১৯৫৮-১৯৬২) কেতাবে;
  • আল-তায়মী নিজ ‘দালাইল আল-নবুওয়াহ’ (পৃষ্ঠা ৫৯-৬০) গ্রন্থে; এবং আল-লালিকাঈ তাঁর শরাহ-এ।
  • এছাড়া, এটি লিপিবদ্ধ আছে ‘উসূলে এ’তেকাদে আহলে সুন্নাহ’ (৪:৭৮০) পুস্তকে।
  • আত-তাবারীর ‘তাফসীর’ (১:৪৪৭-৪৪৮), ইবনে হিব্বানের ‘আল-সিকাত’ (১:১২৮) ও আল-কিলাঈ-এর ‘আল-একতেফা’ (১:৩৪৩) গ্রন্থগুলোতেও এটি বর্ণিত হয়েছে।
  • আবু মা’আদ আল-খুযযা হতে ইবনে সায়াদ (১:২৩০-২৩২)-ও এটি বর্ণনা করেন, তবে এটি মুরসাল এবং আবু মা’আদ একজন তাবেয়ী, যা ইমাম ইবনে হাজর স্বরচিত ’আল-এসাবা’ (#১০৫৪৫) গ্রন্থে ব্যক্ত করেছেন।

যুক্তি খন্ডন

‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ বইটির লেখক দাবি করেছিল মহানবী (দ:) পরের দিন কী ঘটবে তা জানতেন না, কেননা তিনি এক মেয়েকে থামিয়ে দিয়েছিলেন এ কথা বলে “এই বিষয়টি বাদ দাও” যখনই সে আবৃত্তি করেছিল “আমাদের মাঝে এক নবী (দ:) আছেন যিনি আগামীকাল কী হবে তা জানেন”; ওই লেখকের এই অদ্ভূত দাবিকে ওপরে উল্লেখিত ৪ লাইনের পদ্য দুটো নাকচ করে দিয়েছে। [1] হুযূর পাক (দ:)-এর ওই মেয়েকে নিষেধ করার মানে এই নয় যে তিনি গায়ব জানতেন না, বরং এ বিষয়টি সাবেত বা প্রমাণিত যে আল্লাহ
অদৃশ্যের জ্ঞাতা, সুতরাং আপন অদৃশ্যের ওপর কাউকে ক্ষমতাবান করেন না আপন মনোনীত রাসূলগণ ছাড়া
— সূরা জ্বিন, ২৬-২৭ আয়াত)
এবং তিনি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছে শেষ বিচার দিবস অবধি এবং তারও পরের ঘটনাগুলোর ভবিষ্যত জ্ঞান প্রকাশ করেছেন। আসলে নবী পাক (দ:) ওই মেয়েকে এ কখা বলাতে বাদ সেধেছিলেন এই কারণে যে এলমে গায়ব তাঁর প্রতি স্বকীয় পর্যায়ে আরোপ করা হয়েছিল, আর এই স্বকীয়তা একমাত্র আল্লাহরই।[2] ওই মেয়ে এমনই ছোট ছিল যে তার নামায পড়ার বয়সও হয় নি।[3] তার কাছ থেকে এ রকম দাবি করাটা (ওই সময়কার) জনপ্রিয় বিশ্বাসের ইঙ্গিতবহ ছিল, যা নবী (দ:)-এর জন্যে বেমানান হলেও দৈবজ্ঞ, জ্যোতিষী, গণক গংদের এ মর্মে মিথ্যা দাবির প্রতিনিধিত্বকারী ছিল যে তারা নিজেদের ক্ষমতাবলে ভবিষ্যত জানতে পারতো; এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেছেন:
কোনো আত্মা জানে না যে কাল কী উপার্জন করবে
— সূরা লোকমান, ৩৪ আয়াত
তাই মহানবী (দ:) একটি বর্ণনায় আরও ব্যাখ্যা করে বলেন,
শুধু আল্লাহ-ই জানেন আগামীকাল কী ঘটবে।
— ইবনে মাজাহ বিশুদ্ধ সনদে
অর্থাৎ, তিনি স্বকীয় এবং পরিপূর্ণভাবে জানেন।

তথ্যসূত্র



  • রুবাইয়্যে বিনতে মুওয়াব্বেয (রা:) হতে আল-বুখারী; এবং সুনান ও ইমাম আহমদ বর্ণিত।

  • ইমাম ইবনে হাজর (রহ:)-এর ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে উদ্ধৃত তাঁর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য


    1. আবু দাউদের ‘সুনান’-এর ওপর ইবনুল কাইয়েমের হাশিয়া বা টীকা দ্রষ্টব্য
    • মহানবী (দ:)-এর অদৃশ্য জ্ঞানবিষয়ক ৮০টি হাদীস-[ইমাম কাজী ইউসুফ নাবহানী (রহ:)-এর ৯০০ পৃষ্ঠাব্যাপী গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহি আ’লাল আ’লামীন ফী মো’জেযাতে সাইয়্যেদিল মুরসালীন (১৩১৭ হিজরী/১৮৯৯ খৃষ্টাব্দ) হতে সংগৃহীত]-মূল: শায়খ ড: জিবরীল ফুয়াদ হাদ্দাদ দামেশকী-অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

    তাবিজ ও ঝাড়ফুঁক


    আলহাজ্ব মূফতী এস এম সাকীউল কাউছার 
    [সাজ্জাদানশীন, ঘিলাতলা দরবার শরীফ, কুমিল্লা]

    আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মানব দেহে রোগ-বিমার দিয়ে মু’মিনদের পরীক্ষা করেন। আবার রোগের প্রতিষেধকও তিনি দান করেন। আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন -

    و اذا مرضت فهو يشفين -

    (ইব্রাহিম আ: বলেন), “আমি যখন রোগে আক্রান্ত হই তখন তিনি-ই (আল্লাহ) আমাকে রোগমুক্ত
    করেন।” (সূরা শুআরা: আয়াত ৮০)


    বুখারী শরীফে বর্ণিত একখানা হাদীসে রাসূলে পাক (দ:) এরশাদ করেন -


    “আল্লাহ এমন কোনো রোগ প্রেরণ করেন না যার আরোগ্য নেই।


    আল্লাহ্ পাক আরও বলেন -


     
    وننزل من القوأن ما هو شفاء ورحمة للمؤمنين-

    “আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত।“ (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮২)


    আল্লাহ্ তা’আলা আরও এরশাদ করেন -


    ويشف صدور قوم مؤمنين-


    “তিনি মুমিনদের অন্তরের রোগ নিরাময়কারী” (সূরা তওবা: আয়াত ১৪)।


    মানব দেহের রোগ-বিমারের বিভিন্ন দিক থাকতে পারে। যেমন শারীরিক রোগ, মানুষ ও জ্বিনের কুদৃষ্টি, তাবিজ-টোনা ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো এবং এর প্রতিকারে ঝাড়ফুঁক বা তাবিজ-দোয়া ব্যবহার কতটুকু ইসলাম বা কোরআন-হাদীছসম্মত তা নিয়ে কিছু আলোচনা করছি। এ বিষয়ে অনেকে জানতে চেয়েছেন।


    আমাদের প্রথমেই জেনে রাখতে হবে আল্লাহ’র দয়া-রহমত ছাড়া কোনো সাফল্য বা মুক্তি নেই। তাবিজ ও ঝাড়ফুঁকে কাজ হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। এগুলো এক ধরণের দোয়া, আল্লাহ্ পাক ইচ্ছা করলে কবুল করতে পারেন আবার না-ও করতে পারেন। সেজন্য যেমন দোয়া চাওয়া বন্ধ করা যায় না, তেমনি কোরআন-হাদীছকে অবিশ্বাসও করা যাবে না।

    কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব তাবিজ ও ঝাড়ফুঁক-ই বুজুর্গদের ইজতেহাদ, অভিজ্ঞতা ও কাশফের মাধ্যমে উদ্ভূত। কোরান-হাদীছে স্পষ্ট বলা হয়নি যে অমুক তাবিজ বা অমুক ঝাড়ফুঁক দ্বারা অমুক কাজ হবে। তাই কোনো তাবিজে কাঙ্ক্ষিত ফল না হলে কোরআন-হাদীছের সত্যতা নিয়ে কিছু বলার বা ভাবার অবকাশ নেই। যেমন জ্বর বেশি হলে এই আয়াত পড়ে ফুঁ দিলে কাজ হয় - يا نار كونى بردا و سلاما على ابراهيم “ইয়া নারু কুনি বারদাও ওয়া সালামান আলা ইব্রাহিম” যার অর্থ - হে আগুন ইব্রাহিমের (আ:) জন্য শান্তিদায়ক ঠান্ডা হয়ে যাও। কোনো কোনো বুজুর্গ এ আয়াত দ্বারা বালিতে ফুঁ দিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ছিটিয়ে দিয়ে বাড়িঘরে আগুন লাগলে নিভিয়ে দিয়েছেন (সুবহানাল্লাহ)। এখন যদি এ আমল দ্বারা আগুন না নিভে তাহলে কোরআনের ক্ষমতা নেইেএ কথা বলা যাবে না।

    তাবিজ ও ঝাড়ফুঁক কোরআন-হাদীছের বাক্যাবলী ও আল্লাহ্‌র আসমায়ে হুসনা দ্বারা বৈধ উদ্দেশ্যে করা হলে তা জায়েয। পক্ষান্তরে কুফরী-শিরকের কথা দ্বারা বা এরূপ কোনো যাদু হলে তা দ্বারা তাবিজ-ঝাড়ফুঁক হারাম। এমনিভাবে কোনো অবৈধ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাবিজ-ঝাড়ফুঁক করা হলে তা জায়েয নয়, যদিও কোরআন হাদীছের বাক্য দ্বারা হয়।

    মুসলীম শরীফের হাদীছে রয়েছে -

    عن عوف بن مالك الاشجعى قال كنا نرقى فى الجاهلية فقلنا يا رسول الله كيف ترى فى ذالك ؟ فقال اعرضوا على رقاكم لا بآس بارقى ما لم يكن فيه شرك-
    (رواه مسلم فى كتاب الاسلام-باب استحباب الرقية -------- والنظرة )

    অর্থাৎ, হযরত আউফ ইবনে মালিক আশজায়ী বলেন, আমরা জাহেলী যুগে ঝাড়ফুঁক করতাম। তাই জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী? তিনি বলেন, তোমরা কী দিয়ে ঝাড়ফুঁক করো তা আমার কাছে পেশ করো। যাতে শিরক নেই এমন কিছু দিয়ে ঝাড়ফুঁক করাতে দোষ নেই। (মুসলীম শরীফ, কিতাবুস সালাম)

    তাবীজ বা ঝাড়ফুঁক দ্বারা ভালো হলে সেটাকে তাবীজ দাতার বা আমলের বুজুর্গি মনে করা যাবে না। যা কিছু হয় আল্লাহ্’র ইচ্ছা বা দয়ায় হয়, এটা বিশ্বাস রাখতে হবে।

    তাবীজ ও ঝাড়ফুঁক কোরআন হাদীছের বাক্যাবলী দ্বারা বৈধ উদ্দেশ্যে করা হলে তা জায়েয।
    এ সম্পর্কে কয়েকটি দলীল নিম্নে পেশ করা হলো:

    عن عمرو بن شعيب عن ابيه عن جده قال قال رسول الله صلى الله وسلم1 (১)
    اذا فرغ احدكم فى نومه فليقل بسم الله اعوذ بكلمات الله التامات من غضبه وسوء عقابه و من شر عباده و من شر الشياطين -----------------عليه (اخرجه ابن ابى شيبه فى مصنف حديث رقم 24013 )

    এ হাদীছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা:) কর্তৃক তাঁর বাচ্চাদের জন্য তাবীজ লিখে দেয়ার কথা উল্লখ আছে। ( মুসান্নেফে আবি শায়ব হাদীছ নং- ২৪০১৩)।

    (২) عن عمرو بن شعيب عن ابيه عن جده قال قال رسول الله صلى الله وسلم كان يعلمهم من الفزع كلمات اعوذ بكلمات الله------------------- فعلقه عليه- (اخرجه ابو داؤد فى الطب)

    এ হাদীছেও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা:) কর্তৃক তাঁর বাচ্চাদের জন্য তাবীজ লিখে দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। ( আবু দাউদ)
    (৩)
    عن ثوير قال كان مجاهد يكتب للناس التعويذ فيعلقه (اخرخه ابن ابى شيبة حديث رقم 24011)
    و اخرج عن ابى جعفر و محمد بن شرين و عبيد الله بن عبد الله بن عمر و الضحاك ما يدل على انهم كانوا يبيحون كتابه التعويذ و تعليقه او ربطه بالعضد و نحوه- انظر حديث رقم -24012-24013-24015-24018)

    এ রেওয়ায়েতে হজরত মুজাহিদ (রহঃ) কর্তৃক মানুষকে তাবীজ লিখে দেয়ার কথা বর্ণিত আছে এবং আবু জাফর, মুহাম্মদ ইবনে শিরিন (রহ:) আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:)-এর পুত্র উবায়দুল্লাহ ও জাহহাক প্রমুখের দ্বারা অন্যদেরকে তাবীজ লিখে দেয়ার কথা, সূতা বাঁধা, তাবীজ হাতে বা গলায় বাঁধা ও তাবীজ লেখা বৈধ হওয়া মর্মে তাঁদের মন্তব্য বর্ণিত হয়েছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা হাদীছ নং- ২৪০১১, ২৪০১২, ২৪০১৪, ২৪০১৫, ২৪০১৮)

    তাবীজ নিয়ে ইবনে তাইমিয়ার ফতোয়া:

    (৪) قال عبد الله بن احمد قرأ ت على ابى ثنا يعلى بن عبيد ثنا سفيان عن محمد -------- عن ابن عباس قال اذا عسر على المرأة ولادتها فليكتب بسم الله لا اله الا الله الحليم الكريم سبحان الله رب العرش العظيم الحمد لله رب العالمين كانهم يوم يرونها لم يلبثوا الا عشية او ضحاها كانهم يوم يرون ما يوعدون لم يلبثوا الا ساعة من نهار بلاغ فهل بهلك الا القوم الفسقون-

    এ রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) কর্তৃক বাচ্চা প্রসবের সময় প্রসূতির প্রসব বেদনা লাঘব করা ও সহজে প্রসব হওয়ার জন্য বিশেষ তাবীজ শিক্ষা দেয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ রেওয়ায়েতটি সালাফী ও গায়রে মুকাল্লিদগণের সর্বজনমান্য ব্যক্তি ইবনে তাইমিয়া তার ফতোয়ায় উল্লেখ করেছেন। বিঃদ্রঃ ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া - ১৯ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৩।

    বর্তমান যুগের গায়রে মুকাল্লেদ ও সালাফীগণ তাবীজ-কবজকে নিষিদ্ধ, এমনকি
    শিরিক বলে আখ্যায়িত করে। এ প্রসঙ্গে বিরোধীদের মতামত খণ্ডন করে শেষভাগে জবাব দিবো, ইনশা’আল্লাহ! 

    নযর ও বাতাস লাগা


    নযর ও বাতাস লাগা ইসলাম সম্মত কি-না, তা আমাদের জানা থাকা দরকার। অর্থাৎ, সু-নযর বা কু-নযর ও জ্বীনের বাতাস বা আছর সঠিক কি-না?


    হাদীছ শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী নযর লাগার বিষয়টি সত্য। জান-মাল ইত্যাদির প্রতি বদ-নযর লেগে তার ক্ষতি সাধিত হতে পারে। আপনজনের প্রতিও আপনজনের বদ-নযর লাগতে পারে, এমনকি সন্তানের প্রতিও মাতা-পিতার বদ-নযর লাগতে পারে।

     
    হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন -


    العين حق- ( رواه مسلم فى كتاب السلام-باب الطب و المرض و الرقى)


    অর্থাৎ, নযর লাগা সত্য। (মুসলীম শরীফ, কিতাবুস সালাম)


    আর বাতাস লাগার অর্থ যদি হয় জ্বিনের বাতাস বা তাদের খারাপ নযর বা খারাপ আছর লাগা, তাহলে এটাও সত্য; কেননা জ্বিন মানুষের ওপর আছর করতে সক্ষম। কোরআনে আল্লাহ্ পাক বলেন, আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি (সূরা বাক্বারা)। জ্বিনের মধ্যে মানুষের মতই মু’মেন ও বে-দ্বীন এবং দুষ্ট জ্বিনও রয়েছে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একই সাথে ৪০০ জ্বিন ঈমান এনেছিলো। এখনো মক্কা শরীফে মসজিদে জ্বিন রয়েছে। যা হজ্বে গিয়ে আমি নিজেও দেখে এসেছি। এছাড়াও কোরআন শরীফে একটি সূরার নাম রয়েছে ‘সূরায়ে জ্বিন’। সুতরাং আধুনিকতার দোহাই তুলে জ্বিন জাতির অস্তিত্ব অস্বীকার করার কোনো অবকাশ মুসলমানের নেই। এটাও জেনে রাখা দরকার জ্বীন কোনো কোনো জীবের আঁকারও ধারণ করতে পারে এবং মানুষের ওপর ভর করতে পারে।


    কেউ কারও কোনো ভালো কিছু দেখলে যদি ‘মাশা’আল্লাহ’ বলে, তাহলে তার প্রতি তার বদ-নযর লাগে না। আর কারও ওপর কারও বদ-নযর লেগে গেলে যার নযর লাগার সন্দেহ হয় তার মুখ, হাত-কনুইসহ, হাঁটু ধুয়ে সে পানি যার ওপর নযর লেগেছে তার ওপর ঢেলে দিলে খোদা চাহেন তো ভালো হয়ে যাবে।


    হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে -


    عن ابن عباس رضى الله عنه عن النبىِ صلى الله عليه وسلم قال : العين حق ولو كان شىءُ سابق القد ر سبقته العين و اذا استغسلتم فاغسلوا- (رواه مسلم فى كتاب السلام- باب الطب--/ رواه الترمذى فى ابواب الطب- ما جاء ان العين حق والغسل لها وقال: هذا حديث حسن صحيح- واللفظ لمسلم)


    অর্থাৎ, ইবনে আব্বাস (রা:) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, নযর লাগা সত্য। যদি কোনো কিছু ভাগ্য অতিক্রম করতে পারত, তাহলে নযর তাকে অতিক্রম করত। যখন তোমাদের কাউকে ধুয়ে দিতে বলা হয়, সে যেন ধুয়ে দেয়। (মুসলীম শরীফ- কিতাবুস সালাম/ তিরমিজী শরীফ-আবওয়াবাবে তিব্বী- বাবে মা জা’আ ইন্নাল আইনা হাক্কু ওয়া গোসলু লাহা ওয়া কালা হাজা হাদীছুন সহহীহুন)।


    কোরআন শরীফের আয়াত, আল্লাহ’র নাম ও দোয়ায়ে মাছুরা (যে সব দোয়া হাদীছে উল্লেখ আছে) দ্বারা ঝাড়ফুঁক সর্বসম্মতিক্রমে জায়েয। অনেক হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ছাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ঝাড়ফুঁক করতেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এসব ঝাড়ফুঁক ছিল কোরআন ও আসমায়ে হুসনা দ্বারা। এ কারণে এরূপ ঝাড়ফুঁক সর্বসম্মতিক্রমে জায়েয।

    وهى جائزه بالقران والاسماء الالهية وما فى معناها بالاتفاق- (اللمعات)

    অর্থাৎ, কোরআন, আল্লাহ’র আসমায়ে হোসনা ও অনুরূপ অর্থবিশিষ্ট কিছু দিয়ে ঝাড়ফুঁক করা সর্বসম্মতিক্রমে জায়েয। (লুম’আত)

    তবে নিম্নে উল্লেখিত বিষয় দ্বারা ঝাড়ফুঁক জায়েয নয়:

    (১) এমন শব্দ বা বাক্যের অর্থ যা বোধগম্য নয়; (২) আরবী ছাড়া অন্য ভাষায়, তবে অন্য ভাষা হলে কুফুরী বাক্য না থাকা; (৩) কুফুরী-শিরিকী কালাম দ্বারা; (৪) ঝাড়-ফুঁকের মধ্যে নিজস্ব ক্ষমতা আছে মনে করা ইত্যাদি।

    যে সব হাদীছে ঝাড়ফুঁককে নিষেধ করা হয়েছে বা শিরক বলা হয়েছে তা উপরোক্ত ধরনের ঝাড়ফুঁক, সব ধরনের ঝাড়ফুঁক ওই নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত নয়। যেমন আবু দাউদ শরীফের হাদীছ -

    ان الرقى والتمائم والتولة شرك

    অর্থাৎ, ঝাড়ফুঁক ও তাবীজ শিরক।

    পূর্বের হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে বৈধ পন্থায় বৈধ বিষয়ে ঝাড়ফুঁক জায়েয। বর্তমান যুগের গায়রে মুকাল্লিদ ও সালাফীরা তাবীজ-কবজকে নিষিদ্ধ এমনকি শিরক বলে থাকে। পক্ষান্তরে অন্য সকলের কাছে তাবীজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁকের হুকুম একই রকম।

    যে ধরনের কালাম দ্বারা ঝাড়ফুঁক জায়েয নয়, সেগুলো লিখে তাবীজ-কবজ ব্যবহার করাও জায়েয নয়। পক্ষান্তরে, যে ধরনের ঝাড়ফুঁক জায়েয, সে ধরনের কালাম বা তার নকশা (আবজাদ হিসেবে) দ্বারা তাবীজ লিখাও জায়েয। সব শ্রেণির ওলামাগণ এ ধরনের তাবীজ-কবজকে জায়েয বলেছেন। এমনকি সালাফীগণ পদে পদে যার তাকলীদ করেন সেই ইবনে তাইমিয়াও বলেছে -

    ويجوز ان يكتب للمصاب و غيره من المرضى شيئا من كتاب الله و ذكره بلمراد المباح ويغسل وبقسى-
    (فتاوى ابن تيميه ج/19 صفه/ 63)

    অর্থাৎ, অসুস্থ বা বিপদগ্রস্ত লোকদের জন্য কালি দ্বারা আল্লাহ’র কিতাব, আল্লাহ’র জিকির লিখে দেয়া এবং ধুয়ে পান করানো জায়েয।

    গায়রে মুকাল্লীদগণ যে আরেকজনকে ইমাম হিসেবে মান্য করেন, সেই ইমাম শাওকানীও বলেছেন, সমস্ত ফকহীগণের নিকট এ ধরনের তাবীজ জায়েয (নাইলুল আওতার)।


    নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি আমল ছিলো -

    عن عائشة رضى الله عنه انً النًبىً صلًى الله عليه وسلم كان اذا آوى الى فراشه كل ليلة جمع كفيه ثمً نفث فيهما فقرا بهما قل هو الله احد و قل اعوذ برب الفلق و قل اعوذ برب الناس ثمً مسح بهما ما استطاع من جسده يبدا بهما على رأسه و وجهه وما اقبل من جسده يفعل ذالك ثلاث مراتٍ-

    অর্থাৎ, হযরত আয়েশা (রা:) বলেন, প্রতি রাতে বিছানায় শয়ন করার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’হাতের তালু একত্রিত করে তাতে সূরা ইখলাছ,ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিয়ে মাথা ও মুখমণ্ডল হতে সারা শরীর তিন বার মসেহ করতেন। (তিরমিজী শরীফ, ২য় খণ্ড, ১৭৭ পৃষ্ঠা)

    সালাফী ও গায়রে মুকাল্লীদগণের দলীল ও তার জাওয়াব

    সালাফীগণ তাবীজ-কবজ নাজায়েজ হওয়া সম্পর্কে পুস্তিকাও প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে একটি পুস্তিকা হল “আক্বীদাহ’র মানদণ্ডে তাবীজ”।

    তাদের দলীল প্রথমতঃ 
    ওই সব আয়াত যার মধ্যে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদ দূর করাকে আল্লাহ’র শান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন -

    (ক) আল্লাহ্‌ তোমাকে ক্লেশ দিলে তিনি ব্যতীত কেউই তা দূর করার নেই। আর তিনি যদি তোমার মঙ্গল চান তাহলে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউই নেই। (সূরা-ইউনুস, আয়াত-১০৭)

    (খ) আল্লাহ’রই ওপর তোমরা ভরসা করো যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো। ( সূরা মায়েদা:২৩)

    (গ) মু’মিনগণ যেন আল্লাহ’র ওপর-ই ভরসা করে। (সূরা ইব্রাহীম:১১)

    জাওয়াব
    তাবীজ গ্রহণ করা উল্লেখিত আয়াতগুলোর পরিপন্থী হতো যদি তাবীজ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে শুধু তাবীজের ওপরই ভরসা করা হতো। কিন্তু যদি ভরসা আল্লাহ’র ওপর থাকে এবং তাবীজকে ওসীলা হিসেবে গ্রহণ করা হয় যেমনটি করা হয় ওষুধ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে, তাহলে আদৌ তা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী হবে না। নতুবা বলতে হবে বৈধ পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণ করাও উক্ত আয়াতগুলোর পরিপন্থী। এ জাতীয় আয়াত দ্বারা তাবীজ নিষিদ্ধ হওয়ার দলীল দেয়া অনেকটা ছেলেমানুষী এবং ভাষা জ্ঞানে অপরিপক্কতারই পরিচায়ক।

    দ্বিতীয়তঃ

    ওই সব আয়াত যা’তে শিরকের নিন্দাবাদ করা হয়েছে।

    ক) নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না। অন্য গুণাহ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। (সূরা নিসা:১১৬)

    খ) যে ব্যক্তি আল্লাহ’র সাথে শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে পড়ে, অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় কিংবা বায়ু তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করে। (সূরা হজ্ব:৩১)

    জাওয়াব 
    তাবীজের ওপর নিজস্ব প্রভাব বা ক্ষমতা আছে মনে করলে শিরকের প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এ রকম মনে না করলে শিরকের প্রশ্ন অবান্তর। আগেই উল্লেখ করেছি যে তাবীজ গ্রহণ করা জায়েয, তাও শর্ত সাপেক্ষে; এর মধ্যে তাবীজের নিজস্ব ক্ষমতা আছে বিশ্বাস না রেখে আল্লাহ’র রহমতের ওপর বিশ্বাস রাখা শর্ত।

    তৃতীয়তঃ

    ওই সব হাদীছ যা’তে ঝাড়ফুঁক ও তাবীজেকে শিরক বলা হয়েছে -

    ক) যে তাবীজ (পুতি) লটকালো সে শিরক করলো।

    খ) অবশ্যই ঝাড়ফুঁক, তাবীজ ও যাদু শিরক।

    গ) এক হাদীছে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে একদল লোক উপস্থিত হলো। অতঃপর তিনি নয় জনকে বাই’আত করান, কিন্তু একজনকে বাই’আত করেন নি। তারা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! একজনকে বাদ রাখলেন কেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তার সাথে একটি তাবীজ রয়েছে। তখন তাঁর হাত ভিতরে ঢুকালেন এবং তাবীজটি ছিঁড়ে ফেললেন। অতপর তাকেও বাই’আত করালেন এবং বললেন, যে ব্যক্তি তাবীজ ব্যবহার করলো সে শিরীক করলো।

    জাওয়াব

    কিছু উত্তর আগেই দেয়া হয়েছে। এখানে প্রথম হাদীছ দুটোতে যে তাবীজের কথা বলা হয়েছে, তার দ্বারা শিরকপূর্ণ তাবীজ উদ্দেশ্য। তার প্রমাণ হল এখানে উল্লেখিত দ্বিতীয় হাদীছে ঝাড়ফুঁককেও শিরক বলা হয়েছে, অথচ সব ঝাড়ফুঁক শিরক নয়; স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ছাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমও ঝাড়ফুঁক করতেন, যা পূর্বে সহীহ হাদীছের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব, এখানে ঝাড়ফুঁকের বিষয়ে যে ব্যাখ্যা দেয়া হবে তাবীজের ব্যাপারেও একই ব্যাখ্যা দেয়া হবে। এ ব্যাখ্যা করতে আমরা বাধ্য এ কারণেও যে, সহীহ ছাহাবা ও তাবেয়ীনসহ পরবর্তী যুগ পরম্পরায় তাবীজ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
    তৃতীয় হাদীছে তাবীজ থাকার কারণে যে ব্যক্তির বাই’আত না করা এবং তার তাবীজ খুলে ফেলার কথা বলা হয়েছে, এ দ্বারা কোনোভাবেই সব ধরনের তাবীজ নিষিদ্ধ হওয়ার দলীল দেয়া যায় না। কারণ সে লোকটি ইসলাম গ্রহণের জন্যই এসেছিলো। তাই মুসলমান হওয়ার আগে সে যে তাবীজ লাগিয়েছিলো তা অবশ্যই শিরক-পূর্ণ তাবীজ ছিলো। যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষিদ্ধ বলেছেন ও শিরক বলেছেন।

    আশা করি দীর্ঘ দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা ইসলামে তাবীজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁকের বিষয়ে সঠিক ফয়সালা বুঝতে কারো অসুবিধা হবে না। অর্থাৎ, বৈধ উদ্দেশ্যে বৈধ কালাম দ্বারা তাবিজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁক জায়েয। কুফুরী বাক্যাবলী দ্বারা তা জায়েয নেই। ওয়াল্লাহু ওয়া রাসূলাহু আ’লামু।
     

    হজরত মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ:)


    (উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে পথিকৃৎ)


    ❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋❋

    ইমরান বিন বদরী

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
    নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম
    আম্মা বা’দ।
     
    যুগে যুগে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে যেসব মনীষী পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন,যাঁরা অন্যায় ও অসত্যের কাছে কোনোদিন মাথা নত করেননি, ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারা জীবন যারা পরিশ্রম করে গেছেন, তাঁদের অন্যতম হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

    আমাদের মহানবী বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী ইমামুল মুরসালীন, হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওছাল্লাম বলেছিলেন, ’আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি ২টি জিনিস, যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবেনা, আর তা হলো আল্লাহর কোরআন এবং আমার সুন্নাহ।’ ১৪০০ বছর আগের সেই বাণী আজ আমাদের কাছে পৌঁছার পিছনে অনেকেরই অবদান রয়েছে, যাঁদের অন্যতম আল্লাহ পাকের প্রিয় বান্দাগণ, যাঁদেরকে আমরা ওলিআল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু বলে থাকি। 
    এখন প্রশ্ন: ওলি কারা ?

    উত্তর দেয়ার আগে এটা বলা দরকার যে আজকাল আমাদের সমাজে অনেকের মূর্খতাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের কারণে ওলির সংজ্ঞা-ই পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এরা কি আসলে ওলি? পাঠক, আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যদি আপনার জানা থাকে ওলির সংজ্ঞা। আসলে ওলিবৃন্দ তাঁদের ইহকালীন জীবনে বিপথগামী মানুষকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম-এর সুন্নতের রজ্জু আঁকড়ে ধরে সঠিক পথে থাকার দিশারী হিসেবেই কাজ করেন। বন্ধুরা, সত্যের অন্বেষণ করাটাই যেন হয় আমাদের কাজ।

    **ওলি (وليّ) শব্দের অর্থ, আল্লাহর প্রিয়পাত্র/অভিভাবক বা বন্ধু। আরবী ভাষায় “আউলিয়া” শব্দটি “ওলি'র বহুবচন। তাঁরাই আল্লাহর প্রিয়পাত্র হন যারা সত্যিকারভাবে আল্লাহকে ভয় করে জীবন পরিচালনা করেন, সৎ আমল করেন, তাঁর আদেশগুলো বাস্তবায়ন করেন এবং নিষেধকৃত বিষয়গুলো থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখেন এবং কোরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখেন।


    ❋আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ওলি সম্পর্কে ইরশাদ করেন,


    أَلا إِنَّ أَوْلِيَاء اللّهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ


    মনে রেখো যারা আল্লাহর (ওলি) বন্ধু, তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে।


    الَّذِينَ آمَنُواْ وَكَانُواْ يَتَّقُونَ


    যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং ভয় করছে।


    لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَياةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ لاَ تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ


    তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হের-ফের হয় না। এটাই হল মহা সফলতা। (সুরা ইউনুছ আয়াত :৬২-৬৪)


    ❋পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন,


    إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُواْ الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ


    তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মুমিনবৃন্দ, যাঁরা নামায কায়েম করেন, যাকাত দেন এবং বিনম্র।


    وَمَن يَتَوَلَّ اللّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُواْ فَإِنَّ حِزْبَ اللّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ


    আর যারা আল্লাহ তাঁর রসূল এবং বিশ্বাসীদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহর দল এবং তারাই বিজয়ী। ( সূরা মায়িদা,আয়াত ৫৫-৫৬)


    ❋আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে আরো বলেন,


    وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِينَ


    আর আল্লাহ পরহেযগারদের বন্ধু। (সূরা জাসিয়া:১৯)


    ❋আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে আরো বলেছেন -


    وَاللّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ


    আর আল্লাহ হচ্ছেন মুমিনদের বন্ধু। (সূরা আলে ইমরান ৬৮)


    ❋আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে আরো বলেছেন -


    اللّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُواْ يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوُرِ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ أَوْلِيَآؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ


    যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোযখের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে। (সূরা বাকারা ২৫৭)


    ❋আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহে ওছাল্লাম বলেন, যে বান্দার চেহরা দেখলে আল্লাহর কথা মনে পড়ে খোদার ভয় আসে সেই ওলি।


    ❋হাদিসে কুদসিতে আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহে ওছাল্লাম আরো বলেন,


    ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻲ ﻫُﺮَﻳْﺮَﺓَ ﻗَﺎﻝَ ، ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ
    ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻗَﺎﻝَ ﻣَﻦْ ﻋَﺎﺩَﻯ ﻟِﻲ ﻭَﻟِﻴًّﺎ ﻓَﻘَﺪْ
    ﺁﺫَﻧْﺘُﻪُ ﺑِﺎﻟْﺤَﺮْﺏِ ﻭَﻣَﺎ ﺗَﻘَﺮَّﺏَ ﺇِﻟَﻲَّ ﻋَﺒْﺪِﻱ ﺑِﺸَﻲْﺀٍ ﺃَﺣَﺐَّ ﺇِﻟَﻲَّ ﻣِﻤَّﺎ
    ﺍﻓْﺘَﺮَﺿْﺖُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﻣَﺎ ﻳَﺰَﺍﻝُ ﻋَﺒْﺪِﻱ ﻳَﺘَﻘَﺮَّﺏُ ﺇِﻟَﻲَّ ﺑِﺎﻟﻨَّﻮَﺍﻓِﻞِ ﺣَﺘَّﻰ
    ﺃُﺣِﺒَّﻪُ ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺃَﺣْﺒَﺒْﺘُﻪُ ﻛُﻨْﺖُ ﺳَﻤْﻌَﻪُ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻳَﺴْﻤَﻊُ ﺑِﻪِ ﻭَﺑَﺼَﺮَﻩُ ﺍﻟَّﺬِﻱ
    ﻳُﺒْﺼِﺮُ ﺑِﻪِ ﻭَﻳَﺪَﻩُ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﻳَﺒْﻄِﺶُ ﺑِﻬَﺎ ﻭَﺭِﺟْﻠَﻪُ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﻳَﻤْﺸِﻲ ﺑِﻬَﺎ ﻭَﺇِﻥْ
    ﺳَﺄَﻟَﻨِﻲ ﻟَﺄُﻋْﻄِﻴَﻨَّﻪُﻭَﻟَﺌِﻦْ ﺍﺳْﺘَﻌَﺎﺫَﻧِﻲ ﻟَﺄُﻋِﻴﺬَﻧَّﻪُ ﻭَﻣَﺎ ﺗَﺮَﺩَّﺩْﺕُ ﻋَﻦْ
    ﺷَﻲْﺀٍ ﺃَﻧَﺎ ﻓَﺎﻋِﻠُﻪُ ﺗَﺮَﺩُّﺩِﻱ ﻋَﻦْ ﻧَﻔْﺲِ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻦِ ﻳَﻜْﺮَﻩُ ﺍﻟْﻤَﻮْﺕَ ﻭَﺃَﻧَﺎ
    ﺃَﻛْﺮَﻩُ ﻣَﺴَﺎﺀَﺗَﻪُ

     .
    হজরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
    আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার ওলির (বন্ধু) সাথে শত্রুতা করে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। আমার বান্দার প্রতি যা ফরয করেছি তা দ্বারাই সে আমার অধিক নৈকট্য লাভ করে। আমার বান্দা নফল কাজের মাধ্যমেও আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে।  অবশেষে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। যখন আমি তাকে ভালোবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে এবং তার পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে চলাফেরা করে। সে আমার কাছে কিছু চাইলে, আমি তাকে তা দেই। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় কামনা করে, তাহলে আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি যা করার ইচ্ছা করি, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি না, কেবল মুমিনের আত্মার ব্যাপার ছাড়া। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে, আর আমি তার মন্দকে অপছন্দ করি। (সহিহ বুখারী৬৫০২)

    ❋ শেখ সাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, 'মনুষ্যত্ব গোশত, চর্বি ও চর্ম (দেহ) নয়; মনুষ্যত্ব বন্ধু (আল্লাহর) তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছু নয়।

    ✍ সম্মানিত বন্ধুরা,


    এ থেকে আমরা বুঝতে পারি মুমিনরাই আল্লাহর ওলি। যারা ঈমান আনবে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করে
    এবং আল্লাহর অনুগত থেকে নিষিদ্ধ সকল প্রকার হারাম কাজ বর্জন করে তাকওয়া অবলম্বন করবে, আর কোরআন ও সুন্নাহ মত চলবে, তারাই ওলি। আসলে যারা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্রতী থাকেন, তাঁরাই (মোমিন মুত্তাকীরাই) ওলি আল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু।


    ❋এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,


    يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ


    হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরের পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। (সূরা হুজুরাত১৩)

    ✽ পরিচিতি ✽


    হজরত মইনুদ্দিন চিশতী (উর্দু معین الدین چشتی) হলেন চিশতীয়া ধারার ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সুফি সাধক। তিনি গরিবে নওয়াজ (غریب نواز) নামেও পরিচিত। তিনি ভারতে চিশতী ধারার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সিলসিলাকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করেন। পরবর্তীতে তার অনুসারীরা, যেমন, বখতিয়ার কাকী, নিজামুদ্দিন আউলিয়াসহ আরো অনেকে ভারতের ইতিহাসে সুফি ধারাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।
    আত্ম্যাতিক সিদ্ধপুরুষ মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ১১৪১ সালে ৫৩৬ বা ৫৩৭ হিজরি সালে ইরানের খুরাশান (অধুনিক আফগানিস্তানে) সিস্তান প্রদেশের চিশ্ত শহরের উপকণ্ঠে সানজর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাজা গিয়াসুদ্দিন হাসান, মাতার নাম উম্মুল ওয়ারা। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। পিতার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। শৈশবে কুরআন হিফজ-ও করেন। জ্ঞানার্জনের জন্য প্রথমে সমরকন্দ ও পরে বোখারা গমন করেন। বোখারায় তিনি মাওলানা শরফুদ্দিন ও মাওলানা হাসান উদ্দিনের মতো জগদ্বিখ্যাত আলেমদের কাছে এলমে শরিয়তের জ্ঞান অর্জন করেন। পিতার উত্তরাধিকার হিসাবে একটি ছোট আঙ্গুরের বাগান থেকে জীবিকা অর্জন করা শুরু করেন। এ বাগানে একদিন কাজ করার সময়ে সুফি ইব্রাহিম কান্দুজি নামের একজন আল্লাহওয়ালা বুজুর্গের সংস্পর্শে এসে তার জীবনের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি একজন মানবসেবক ও আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন। কোরআন ও হাদিসের গভীর জ্ঞান অর্জন করার পর তিনি আত্মশুদ্ধির জ্ঞান অর্জনের জন্য হক্কানি পীর-মাশায়েখদের সন্ধানে সিরিয়া, হামাদান, কিরমান, তাবরিজ, বোখারা, সমরখন্দ, আস্তারাবাদ, হিরাত, বালখ প্রভৃতি স্থান সফর করেন। অবশেষে বোখারা থেকে নিশাপুরে আসেন। সেখানে চিস্তিয়া তরীকার অপর প্রসিদ্ধ ছুফি সাধক হজরত ওসমান হারুনি চিশতি (রহ.)-এর কাছে বায়াত হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে মনোনিবেশ করেন এবং একজন পরিপূর্ণ মোমিন হিসেবে নিজেকে বিকশিত করেন। মানুষকে সত্য ও সুন্দরের এবং ইসলামের শান্তি বাণীর সন্ধান দেওয়াই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। ৫৮৩ হিজরীতে তিনি পবিত্র হজ্ব ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ যান। তিনি আরব থেকে ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে ভারতের আজমিরে বসতি স্থাপন করেন।

    ✽ ধর্ম প্রচার ✽


    হজরত মঈনুদ্দিন চিশতি রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক ছুফি ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজ পীর উসমান হারুনীর নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তাঁরই মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ভারতবর্ষে আগমনে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। একথা সত্য যে,তাঁর আগমনের বহু আগেই ইসলাম ও মুসলমানদের ভারতবর্ষে আগমন ঘটে এবং অনেক সুফী সাধক ইসলাম প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করেন। কিন্তু হজরত মঈনুদ্দিন চিশতি রহমাতুল্লাহি আলাইহির আগমনে ইসলাম প্রচারে এক বিপ্লব ঘটে এবং তা একটি সামাজিক বিপ্লবেও রূপান্তরিত হয়। সামাজিক নানা কুসংস্কার ও বদ কার্যকলাপ বিদূরিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় প্রচুর মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা। তাঁর প্রচেষ্টায় লাখ লাখ পথহারা সত্যবিমুখ মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁর এ সাফল্যের মূলে ছিল সুদৃঢ় ঈমান, কঠোর সাধনা ও নেক আমল। এছাড়া পবিত্র কোরআন ও হাদিসের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক, তেজোদীপ্ত প্রভাব বিস্তারকারী আধ্যাত্মিক শক্তি, আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ মানবসেবা, ইসলামি শিক্ষার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও তরিকার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রভৃতি। পৃথ্বিরাজের শাসনামলেই আজমিরের বাইরেও বদায়ুন, বেনারস, কনৌজ, নাগুর ও বিহারে তিনি খানকা তৈরি করেছিলেন।


    এই মহান সাধকের সময়ে আফগানিস্তানের অন্তর্গত ঘোর প্রদেশের শাসনকর্তা শাহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘোরী ভারত আক্রমণ করেন। দিল্লীর সন্নিকটে উভয়ের মধ্যে চরম যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে দেড়শ ভারতীয় রাজন্যবর্গ পৃথ্বীরাজের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁদের সকল প্রতিরোধ চূর্ণ করে ঘোরী বিজয়ী হন এবং পৃথ্বীরাজকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করা হয়। এভাবে এই মহান সাধকের দোআয় এই অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ রেহাই পান।

    ✽ বেসাল শরীফ ✽


    আল্লাহর এ আধ্যাত্মিক অলি ১২৩৬/১২৩৭ সালে ৬৩২/৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত, অর্থাৎ, ৬ রজব সূর্যোদয়ের সময় রাতের কোনো এক সময় পরিপূর্ণভাবে সত্যের আলো প্রজ্জ্বলিত করে দিয়ে সবার অজান্তেই বেসাল (পরলোকে খোদার সাথে মিলন)-প্রাপ্ত হন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। তাঁর বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী (রহঃ) তাঁর নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। ভারতের আজমির-সংলগ্ন তারাগড় পাহাড়ের পাদদেশে (আজমির শরীফে) তাঁর সমাধিস্থল অবস্থিত।



    বস্তুতঃ গরিব নওয়াজ-ই উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক। নিখিল ভারতে ইসলামের ভিত্তিকে সুদৃঢ়ভাবে তিনি-ই স্থাপন করেছেন, আর তাঁরই দোয়ায় ভারতবর্ষে মুসলিম রাজত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
    No comments:

    তাসাউফ অর্জন ও বাইয়া’ত গ্রহণ




    আলহাজ্ব মুফতী গাজী সাইয়্যেদ মুহাম্মদ সাকীউল কাউছার (মা:)
    (ডাবল টাইটেল ফার্স্ট ক্লাস-বিএ)
    নায়েব-ই সাজ্জাদানশীন, ঘিলাতলা দরবার শরীফ, কুমিল্লা।

     
    ইসলামে তাসাউফ তথা শরীয়তের পাশাপাশি তরীকত হাকীকত ও মারেফাত অর্জন এবং সে জন্য পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত গ্রহণ একটি অত্যাবশকীয় বিষয় যা কোরআন হাদীছ ইজমা ও ক্বিয়াস দ্বারা সাব্যস্ত।


    এ প্রসঙ্গে প্রথমে আমি মহান কোরআনুল কারীমের আয়াত শরীফ উল্লেখ করছি। আল্লাহ পাক বলেন - 


    لقد من الله على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم يتلوا عليهم أيته يزكيهم و يعلمهم الكتب والحكمة و ان كانوا من قبل لفى ضلل مبين-
     

    (লাকাদ মান্নাল্লাহু আলাল মু’মিনীনা ইঁজ বা'আছা ফীহিম রাছুলাম মিন আনফুছিহিম ইয়াতলু আলাইহিম আ-ইয়াতিহী ওয়া ইয়ূজাক্কিহিম ওয়া ইয়ূ আল্লীমুহুমুল কিতাবা ওয়াল হিকমাহ ওয়া ইন কানু মিন কাবলু লাফী দ্বালা-লিম মুবীন)।

    অর্থাৎ, মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ পাকের বড়ই ইহসান যে তাদের মধ্যে হতে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি আল্লাহ পাকের আয়াতগুলো তেলায়াত করে শুনাবেন, তাদেরকে তাজকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন এবং কিতাব ও হিকমত (আধ্যাত্মিক) জ্ঞান শিক্ষা দিবেন। যদিও তারা পূর্বে হেদায়েত প্রাপ্ত ছিল না। (সূরা আল এমরান, আয়াত-১৬৪)


    অনুরূপভাবে, সুরা বাকারা’র ১২৯ ও ১৫১ নং আয়াত শরীফে উপরোক্ত আয়াত শরীফের সমার্থবোধক আয়াতে কারীমার উল্লেখ আছে। মূলতঃ উল্লেখিত আয়াত শরীফে বিশেষভাবে চারটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে: তন্মধ্যে আয়াত শরীফ তেলাওয়াত করে শুনানো এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া, এ তিনটি বিষয় হচ্ছে এলমে জাহির বা ইলমে ফিকাহ এবং ইলমে মারেফতের অন্তর্ভুক্ত। যা এবাদাতে জাহের বা দ্বীনের যাবতীয় বাহ্যিক হুকুম আহকাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিন জীবন যাপনে হালাল কামাই করার জন্য প্রয়োজন। আর চতুর্থ হচ্ছে তাজকিয়ায়ে "ক্বলব", অর্থাৎ, অন্তর পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করা। মুফাসসিরীনে কিরামগণ "ইউযাক্কীহিম"-এর ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ তাফসীরের কিতাব, যেমন তাফসীরে জালালাইন-কামালাইন, বায়হাকী, ইবনে কাছীর, রুহুল বয়ান, তাফসীরে মাযহারী, মা’রেফুল কোরআন-সহ আরও অনেক তাফসীরে তাজকিয়ায়ে ক্বলব বা অন্তঃকরণ পরিশুদ্ধ করাকে ফরজ বলেছেন এবং তজ্জন্যে এলমে তাসাউফ অর্জন করাও ফরজ বলেছেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুফাসসিরে ফকিহুল উম্মত হযরত মাওলানা শায়খ ছানাউল্লাহ পানি পথি (রহ:) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীরে মাযহারী’-তে উল্লেখ করেন, যে সকল লোক ইলমে লা-দুন্নী বা ইলমে তাছাউফ হাছিল করেন তাঁদেরকে সূফি বলে। তিনি ইলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ আইন বলেছেন। কেননা, ইলমে তাছাউফ মনকে বা অন্তঃকরণকে গায়রুল্লাহ হতে ফিরিয়ে আল্লাহ পাকের দিকে রুজু করে দেয়। সর্বদা আল্লাহ পাকের হুজুরী পয়দা করে দেয় এবং ক্বলব্ বা মন থেকে বদ খাছলত-সমূহ দূর করে নেক খাছলত-সমূহ পয়দা করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দেয়।


    আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য ইলমে তাসাউফ যে ফরজ, এ প্রসঙ্গে আফজালুল মুফাসসিরীন আল্লামা হযরত ইসমাঈল হাক্কি (রহ:) তাঁর ‘তাফসীরে রুহুল বয়ানে’ উল্লেখ করেন যে, দ্বিতীয় প্রকার ইলম হচ্ছে ইলমে তাছাউফ যা ক্বলব বা অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মু’মিনের জন্য ফরজ।


    এলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ হওয়া সম্পর্কে ‘জামিউল উসুল’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, এলমে তাছাউফ বদ খাছলত-সমূহ হতে নাজাত বা মুক্তি পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। পক্ষান্তরে, আল্লাহ-প্রাপ্তি, রিপু বিনাশ ও সংযম শিক্ষার একমাত্র পথও। এই জন্য ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করা ফরজে আইন।


    মূলতঃ শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারেফত, এ সবের প্রত্যেকটি-ই কোরআন সুন্নাহসম্মত এবং তা মানা ও বিশ্বাস করে কার্যে পরিণত করা কোরআন-সুন্নাহ’র-ই নির্দেশের অর্ন্তভুক্ত।


    আল্লাহপাক তাঁর কালাম পাকে এরশাদ করেন -


    لكل جعلنا منكم شرعة و منهاجا “লি-কুল্লিন-জ্বায়াল না মিনকুম শির’আতাউ ওয়া মিনহাজ”।


    অর্থাৎ, আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি জীবন বিধান বা শরীয়ত, অপরটি তরীকত-সম্পর্কিত বিশেষ পথ নির্ধারণ করে দিয়েছি। (সূরা মাইয়িদা, আয়াত ৪৮)


    আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে আরও এরশাদ করেন -

    و ان لواستقاموا على الطريقة- (ওয়া আল লাওয়িস্তেকামু আলাত তারীকাতে- সূরা জ্বিন আয়াত ১৬)


    অর্থাৎ, তারা যদি তরীকতে (সঠিক পথে) কায়েম থাকতো। অতএব, তরীকত শব্দটি কোরআন শরীফে রয়েছে।


    আর হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে -


    الشَّريةٌ شَجرَةٌ وَ الطَّرِيقَةُ اَغصَانُهَا وَ المَعرِفَةُ اَورَقُهَا وَ الحَقِيقَةُ ثَمَرُهَا
    -
     

    অর্থাৎ, শরীয়ত একটি বৃক্ষস্বরূপ, তরীকত তার শাখা প্রশাখা, মারেফাত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল । (সিসরুল আসরার)

    হাদীস শরীফে আরও এরশাদ হয়েছে - 


    اَلشَّرِيعَةُ اَقوَالِى وَ الطَّرِقَةُ اَفعَالِى وَالحَقِيقَةُ اَحوَالِى وَالمَعرِيفَةُ اَسرَارِى-
     

    অর্থাৎ, শরীয়ত হলো আমার কথাসমূহ (আদেশ-নিষেধ), তরীকত হলো আমার কাজসমূহ (আমল), হাকীকত হলো আমার গুপ্ত রহস্য। (ফেরদাউস)

    উল্লেখ্য যে, উক্ত শিক্ষা বা এলমে তাছাউফ অর্জন করার ও এছলাহে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে এমন কোনো কামেলে-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া, যিনি ফয়েজ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এখন প্রশ্ন হলো, এছলাহে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করা যদি ফরজ হয়, আর তা লাভ করার মাধ্যম বাইয়া’ত হয়, তবে বাইয়া’ত হওয়া নাজায়েজ হয় কী করে?


    তরীকত যথাযথভাবে পালন করতে হলে দ্বীনী এলেম অর্জন করতে হবে যা ফরজ। এই এলেম দু'প্রকার- ১) ইলমে ফিকাহ, ২) ইলমে তাছাউফ।


    ইলমে ফিকাহ: ইলমে ফিকাহ দ্বারা এবাদাতে জাহেরা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়। ইলমে তাছাউফ-এর দ্বারা এবাদাতে বাতেন বা অভ্যন্তরীন অবস্থা পরিশুদ্ধ হয়ে ইখলাছ অর্জিত হয়। এ মর্মে হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে - 


    عن الحسن رضى الله عنه قال العلم علمان فعلم فى القلب فذاك العلم النافع و علم على للسان فذالك حجة الله غز و جل على ابن ادم-
     

    (আনিল হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ক্বালা আল এলমু এলমানে ইলমু ফিল ক্বালবে ফাজাকাল ইলমুন নাফেউ ওয়া ইলমুল আলাল লেছানি ফাজাকা হুজ্জাতুল্লাহে আলা এবনে আদামা)। অর্থাৎ, এলেম দু'প্রকার (১) ক্বালবী এলেম। এটা হলো উপকারী এলেম। (২) লিসানী বা জবানী এলেম। এটা হলো আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে আদম সন্তানদের প্রতি দলীলস্বরূপ। (মিশকাত শরীফ)

    আর এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মালিকী মজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম, ইমামুল আইম্মা রঈসুল মুহাদ্দিসীন ফখরুল ফুকাহা শায়খুল উলামা হযরত ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন -


    مَن تَفَقَّهَ وَ لَم يَتَصَوَّفَ فَقَد تَفَسَّقَ وَ مَن تَصَوَّفَ وَ لَم يَتَفَقَّهَ فَقَد تَزَندَقَ وَ مَن جَمَعَ بَينَهُمَا فَقَد تَحضقَّقَ-
     

    অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এলেম ফিকাহ (জবানী এলেম) অর্জন করলো, কিন্তু এলেম তাছাউফ (ক্বালবী) এলেম অর্জন করলো না, সে ব্যক্তি ফাসিক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাছাউফের দাবি করে, কিন্তু শরীয়ত স্বীকার করেনা, সে ব্যক্তি যিন্দীক (কাফের); আর যে ব্যক্তি উভয় প্রকার এলেম অর্জন করলো সে ব্যক্তি মুহাক্কিক তথা মু’মিনে কামেল। (মিরকাত, কিতাবুল ইলম)

    অর্থাৎ, এলমে ফিকাহ ও এলমে তাছাউফ উভয় প্রকার এলেম অর্জন করে দ্বীনের ওপর সঠিকভাবে চলার চেষ্টা করা প্রত্যেকের জন্য ফরজ। বর্তমান মুসলমানের কাছে আসল সত্য জিনিস বা শিক্ষা না থাকাতে মানুষ প্রকৃত মু’মিন হতে পারছে না। কেবল মাত্র ক্বলব নামের অমূল্য রত্নটা হস্তগত করতে জীবনের সব সময়ই চলে যায়, তবে মানুষ খাঁটি ঈমানদার হবে কবে। এ জন্য আমরা চিন্তা ফিকির করি না। তরীকতের এমন সরল সহজ পথ অবলম্বন করা দরকার যাতে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে উক্ত নেয়ামত পেতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, উক্ত নেয়ামত বা এলমে তাছাউফ অর্জন করার ও এছলাহে নফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কোনো কামেলে-মোকাম্মেল পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া। এখন প্রশ্ন হলো তাজকিয়ায়ে নাফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করা যদি ফরজ হয়, আর তা লাভ করার মাধ্যম বাইয়া’ত হয়, তবে বাইয়া’ত হওয়া নাজায়েজ হয় কী করে? কেননা উছুল-ই রয়েছে যে আমলের দ্বারা ফরজ পূর্ণ হয় এবং সেই ফরজকে পূর্ণ করার জন্য সে আমল করাও ফরজ। উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন: যেমন এ প্রসঙ্গে "দুররুল মুখতার" কিতাবে উল্লেখ আছে, যে আমল ব্যতিরেকে ফরজ পূর্ণ হয় না বা আদায় হয় না, সে ফরজ আদায় করার জন্য সে আমলটাও ফরজ। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নামাজ আদায় করা ফরজ। আর এ নামাজ আদায় হওয়ার একটি শর্ত হচ্ছে পবিত্রতা অর্জন করা, অর্থাৎ, ওজু। যখন কেউ নামাজ আদায় করবে, তখনই তার জন্য ওযু করা ফরজ হয়ে যাবে। যেহেতু ওজু ছাড়া নামাজ হবে না, ঠিক তদ্রুপ-ই এলমে তাছাউফ অর্জন করা ফরজ। আর বাইয়া’ত হওয়াও ফরজ। আর হাদীস শরীফের ভাষায় এ ধরণের ফরজকে অতিরিক্ত ফরজ বলে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই উক্ত হাদিসে বর্ণিত অতিরিক্ত ফরজের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মাজহাব মানা, বাইয়া’ত হওয়া ইত্যাদি।


    বস্তুতঃ পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হতে হবে। এটা মহান আল্লাহ পাকের কালামে অসংখ্য আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত। যদি এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহাজ্ঞানী ব্যক্তিবর্গগণ নিজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য না মানেন, তবে কার কী বলার আছে। তাদেরকে যতোই বোঝানো হউক না কেন, কিছুতেই তারা বোঝার চেষ্টা করবে না; বা বুঝতে সক্ষম হয় না। তাদের ক্বালবে সীলমোহর মারা আছে।


    সূফীকুল শিরোমনি আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমী (রহ:) বলেন -


    ‘ইলমে জাহের হাম চুঁ মসকা, ইলমে বাতেন হাম চুঁ শীর
    কায় বুয়াদে বে শীরে মসকা, কায় বুয়াদে বেপীরে পীর’।


    অর্থাৎ, ইলমে জাহের জানো দুধের মেছাল (উপমা), আর বাতেন জানো মাখনের মেছাল, দুধ ছাড়া মাখন কীভাবে হয় আর পীরের আনুগত্য ছাড়া পীর কীভাবে হয়। (মসনবী শরীফ)


    এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে এরশাদ করেন -


    ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﻛُﻮﻧُﻮﺍ ﻣَﻊَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴﻦَ
     

    (ইয়া আইয়্যুহাল্লাজীনা আ-মানুত্তাক্কুলা ওয়া কুনু মা’আছ্ছাদিকীন)।

    অর্থাৎ, "হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ পাককে ভয় করো, আর ছাদেকীনদের সঙ্গী হও" (সূরা তওবা, আয়াত-১১৯)। এ আয়াত পাকে আল্লাহ পাক মূলতঃ পীর-মাশায়েখগণের সঙ্গী বা সোহবত এখতিয়ার করার কথা বলেছেন। কারণ হক্কানী মুর্শিদগণ-ই হাকীকি ছাদেকীন।


    আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তা’আলা কোরআন শরীফের প্রথম সূরাতেই শিখিয়ে দিচ্ছেন -


    ﺍﻫْﺪِﻧَﺎ ﺍﻟﺼِّﺮَﺍﻁَ ﺍﻟْﻤُﺴْﺘَﻘِﻴﻢَ ﺻِﺮَﺍﻁَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻤْﺖَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ
     

    অর্থাৎ, আমাদের সরল সঠিক পথ [সীরাতে মুস্তাকিম] দেখাও। তাঁদের পথ যাঁদেরকে তুমি নিয়া’মত দান করেছো। {সূরা ফাতিহা, ৬-৭}

    সূরায়ে ফাতিহায় মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা যে পথে চলেছেন, সেটাকে সাব্যস্ত করেছেন সীরাতে মুস্তাকিম।


    আর তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা হলেন -


    ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻢَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨَّﺒِﻴِّﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺼِّﺪِّﻳﻘِﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺸُّﻬَﺪَﺍﺀِ ﻭَﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴﻦَ
     

    অর্থাৎ, যাদের ওপর আল্লাহ তা’আলা নিয়ামত দিয়েছেন, তাঁরা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও নেককার বান্দাগণ। {সূরা নিসা, ৬৯}

    এ দু’আয়াত একথাই প্রমাণ করছে যে, নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, আর নেককারগণ তথা আল্লাহ’র অলীগণ।যাঁদের শানে আল্লাহ্‌ নিজেই ঘোষণা দেন -


    ألاَ اِنَّ اَولِياَء اللهِ لاَ خَوفٌ عَلَيهِم وَلَاهُم يَحزَنُون-
     

    অর্থাৎ, সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহ’র অলী বা বন্ধুগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁদের কোনো চিন্তা-পেরেশানী নেই। (সূরা ইউনূস, ৬২)

    আর ওই সকল প্রিয় বান্দাদের পথ-ই সরল সঠিক তথা সীরাতে মুস্তাকিম। অর্থাৎ, তাঁদের অনুসরণ করলেই সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলা হয়ে যাবে। যেহেতু আমরা নবী দেখিনি, দেখিনি সিদ্দীকগণও, দেখিনি শহীদদের। তাই আমাদের সাধারণ মানুষদের কুরআন সুন্নাহ থেকে বের করে সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলার চেয়ে একজন পূর্ণ শরীয়ত-তরীকতপন্থী হক্কানী বুযুর্গের অনুসরণ করার দ্বারা সীরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলাটা হবে সবচেয়ে সহজ। আর একজন শরীয়ত সম্পর্কে প্রাজ্ঞ আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তির সাহচর্য গ্রহণ করার নাম-ই হল পীর-মুরিদী বা তাসাউফ অর্জন ও বাইয়া’ত গ্রহণ।


    আল্লাহ পাক তাঁর পাক কালামে আরো এরশাদ করেন —


    يا ايها الذين امنوا وابتغوا اليه الوسيلةَ وَ جَاهِدُوا فِى سَبِيلِهَ لَعَلَّكُم تُفلِحُون-
     

    (ইয়া আইয়্যূলহাল্লাজীনা আ-মানুত্তা কুল্লাহা অবতাগু ইলাইহিল অছিলাতা অ জ্বা-হিদু ফি ছাবিলিহী লা’আল্লাকুম তুফলিহুন)। অর্থাৎ, "হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহপাককে ভয় করো, আর তাঁর সন্তষ্টি লাভের জন্য উছিলা গ্রহণ করো (সুরা মায়িদা, আয়াত-৩৫)।

    মুফাসসিরীনগণ বলেন, উল্লেখিত আয়াত শরীফে বর্ণিত উছিলা দ্বারা তরীকতের মাশায়েখগণকে বোঝানো হয়েছে। যেমন তাফসীরে রুহুল বয়ানে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে -‘আল ওয়াসলু লা ইয়াহছিলু ইল্লা বিল উছিলাতে ওয়াহিয়া ওলামায়ে মুহাক্কেকীনা ওয়া মাশায়েখুত তরিকত’, অর্থাৎ, উক্ত আয়াতে উছিলা ছাড়া উদ্দেশ্যকে (আল্লাহ্‌কে) লাভ করা যাবেনা, আর সে উছিলা হলো মুহাক্কীক আলেম বা যিনি তরীকতের শায়খ বা পীর। যদিও অনেকে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান সদকা, জিহাদ ইত্যাদিকে উছিলা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাকিকতে পীর-মাশায়েখগণই হচ্ছেন প্রধান ও শ্রেষ্ঠতম উছিলা। কারণ পীর-মাশায়েখগণের কাছে বাইয়া’ত হওয়া ছাড়া তাজকিয়া নাফস বা আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয় না। আর আত্মশুদ্ধি ব্যতিরেকে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ, তাবলীগ কোনো কিছুই আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হয় না বা নাজাতের উছিলা হয় না। তাই দেখা যাবে অনেক লোক নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান ছদকা, জিহাদ, তাবলীগ ইত্যাদি করেও এক লাফে জাহান্নামে যাবে। যেমন আল্লাহ পাক বলেন,فويل للمصلين (ফাওয়াইলুল্লিলমুছাল্লিন); অর্থাৎ, মুসুল্লীদের জন্য জাহান্নাম (সূরা মাউন, আয়াত-৭)। কোন মুসুল্লী জাহান্নামে যাবে - যে মুছল্লী তাজকিয়ায়ে নাফসের মাধ্যমে অন্তর থেকে রিয়া দূর করে "ইখলাছ" হাছেল করেনি, তাই সে মানুষকে দেখানোর জন্য নামাজ আদায় করছে। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য নামাজ আদায় করেনি। আল্লাহ বলেন, "আল্লাজিনা হুম ইউরা-উন"। অর্থাৎ, তারা ওই নামাজি যারা রিয়ার সহকারে নামাজ আদায় করেছে (সূরা-মাউন, আয়াত-৬)।
    একটি হাদীছ শরীফ উল্লেখ করলাম যাতে আপনারা বুঝতে পারেন। মুসলিম শরীফের ছহীহ হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে কেয়ামতের দিন শহীদ, দানশীল ও দ্বীন প্রচারকারী আলেম, এ তিন প্রকার লোক থেকে কিছু লোককে সর্বপ্রথম জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, যেহেতু তারা এখলাছের সাথে জিহাদ, তাবলীগ, দান ছদকা ইত্যাদি করেনি। যে সব আলেম বলে থাকে কোরআন শরীফে বর্ণিত উছিলা হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ ইত্যাদি, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন: তাহলে নামাজ আদায় করে জিহাদ করে ইলিয়াছি তাবলীগ করেও বান্দা জাহান্নামে যাবে কেন? কেনো উক্ত আমলসমূহ তার জন্য নাজাতের উছিলা হলো না? নিশ্চয়ই আপনারা বলবেন, তাদের এখলাছ ছিল না। কেন এখলাছ ছিল না? তারা কামেলে-মোকাম্মেল পীরের কাছে বাইয়া’ত হয়ে এলমে তাছাউফ আমলের মাধ্যমে তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি লাভ করে এখলাছ অর্জন করেনি। তাহলে বোঝা গেল, পীর-মাশায়খগণ হচ্ছেন প্রধান ও শ্রেষ্ঠতম উছিলা, তথা উছিলাসমূহের উছিলা। কারণ তাঁদের কাছে বাইয়া’ত হওয়ার উছিলাতেই এছলাহ লাভ হয়, এখলাছ অর্জিত হয়। যার ফলে নামাজ, রোজা, জিহাদ, দান খয়রাত ইত্যাদি কবুল হয় বা নাজাতের উছিলা হয়।


    কামেল পীর-মুর্শিদের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন -


    من يهد الله فهو المهتد و منيضلل فلن تجد له وليا مرشدا-
     

    (মাই ইয়াহদিল্লাহু ফাহুয়াল মুহতাদে ওয়ামাই ইয়ুদ্বলিল ফালান তাজিদালাহু ওলিইয়্যাম মুর্শেদা)

    অর্থাৎ, যে ব্যক্তি হেদায়েত চায় আল্লাহ পাক তাকে হেদায়ত দেন, আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর মধ্যে দৃঢ় থাকে সে কখনও অলিয়ে কামেল মুর্শিদ খুঁজে পাবে না (সূরা-কাহাফ, আয়াত-১৭)। উক্ত আয়াত শরীফের দ্বারা মূলতঃ এটাই বোঝানো হয়েছে যে ব্যক্তি কোনো কামেল-মোকাম্মেল পীর সাহেবের কাছে বাইয়া’ত হয়নি, সে ব্যক্তি গোমরাহ।


    আল্লাহ্‌ পাক আরও মুর্শিদের আনুগত্যের বিষয়ে এরশাদ করেন -


    أَطِيعُوا الله وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِى الآَمرِ مِنكُم-
     

    অর্থাৎ, আনুগত্য করো আল্লাহ’র, আনুগত্য করো রাসূলের এবং যারা তোমাদের মধ্যে হুকুমদাতা। (সূরা নিসা, আয়াত নং ৫৯)

    উক্ত আয়াতে কারীমায় ‘ তোমাদের মধ্যে যারা হুকুমদাতা (উলিল আমর)’ দ্বারা শরীয়ত ও তরীকতের আলেমকে বোঝানো হয়েছে। এটাই বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মত।


    আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন- يوم ندعوا كل اناس بامامهم অর্থাৎ, সেই দিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমামের (শায়খের) নামে আহ্বান করবো। (সূরা বনি ইসরাঈল)


    এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে “আ’রায়েসুল বয়ান”-এ উল্লেখ রয়েছে, “ওয়া ইয়াদ’উল মুরীদিনা বে আসমায়ে মাশায়েখেহীম”। অর্থাৎ, হাশরের দিন প্রত্যেক মুরীদকে ডাকা হবে যার যার শায়খ বা পীরের নামে। তাই পীরের দলভুক্ত হয়ে আল্লাহ’র দরবারে হাজিরা দিতে হবে।


     বাইয়াত

     
    “বাইয়া’ত” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, “বাইয়ু’ন” শব্দ থেকে।“বাইয়ু’ন” শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “ক্রয়-বিক্রয়”। এখানে এই “ক্রয়-বিক্রয়” মানে হচ্ছে আমার আমিত্বকে আল্লাহর রাহে রাসূল (দ:) বা নায়েবে রাসূলের কাছে কোরবান করে দিলাম, বিলীন করে দিলাম, বিক্রি করে দিলাম। আমার আমিত্ব, আমার যতো অহংকার আছে, অহমিকা আছে, আমি আমি যতো ভাব আছে, সমস্ত কিছু আল্লাহর রাসূল (দ:) বা নায়েবে রাসূলের কাছে আল্লাহর রাহে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করে দেয়া, কোরবান করে দেয়া, বিক্রি করে দেয়া, এবং পক্ষান্তরে, রাসূল (স:)-এর কাছ থেকে কোরআন সুন্নাহ-ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা খরিদ করে, সমস্ত উপাসনার মালিক আল্লাহ, এবাদতের মালিক আল্লাহ, কুল মখলুকাতের মালিক আল্লাহ, এই দৃঢ় ঈমানে ঈমানদার হয়ে যাওয়া, এটাকেই বলা হয় বাইয়াত বা “ক্রয়-বিক্রয়”।


    আল্লাহ্‌ রাব্বুল ইজ্জত এরশাদ করেন -


    آَ نَّ اللهَ اَشتَرَى مِنَ المُؤمِنِينَ اَنفُسَهُم وَ اَموَالَهُم بِاَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِى سَبِيلِ اللهِ فَيَقتُلُونَ وَ يُقتَلُونَ وَعدَا عَلَيهِ حَقَّا فِى التَّورة وَالاِنجِيلِ وَالقُرأنِ وَ مَن اَوفى بِعَهدِهِ مِنَ اللهِ فَاستَبشِرُوا بِبَيعِكُمُ الَّذِى بَايَعتُمْ بِهِ وَ ذًالِكَ هُوَ الْفًوْزُ الْعَظِيمُ-
     

    অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন মু’মিনদের থেকে তাদের জান ও মাল এর বিনিময়ে যে, অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, কখনও হত্যা করে এবং কখনও নিহত হয়। তাওরাত ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আল্লাহর চাইতে নিজের ওয়াদা অধিক পালনকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আনন্দ করো তোমাদের সে সওদার জন্য যা তোমরা তাঁর সাথে করেছ। আর তা হলো মহা সাফল্য। (তাওবা:১১১)

    لَقَد رَضِىَ الله عَنِ المُؤمِنِينَ اِذ يُبَايِعُونَكَ تَحتَ الشَّجَرَةِ-
     

    অর্থাৎ, হে রাসূল! আল্লাহ মু’মিনদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার কাছে বাইয়া’ত হচ্ছিল। (সূরা ফাতহা : ১৮)

    * যে ব্যক্তি তার ওয়াদা (প্রতিশ্রুতি) পূর্ণ করবে এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করবে, সে আল্লাহ পাকের প্রিয়জন হবে। আর নিশ্চিতভাবে আল্লাহ পাক মুত্তাকীদের ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান: ৭৬)


    o ﺇِﻥَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌُﻮﻧَﻚَ ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌُﻮﻥَ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻳَﺪُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓَﻮْﻕَ ﺃَﻳْﺪِﻳﻬِﻢْ
     

    অর্থাৎ, হে রাসূল! যেসব লোক আপনার কাছে বাইয়া’ত হচ্ছিল, তারা আসলে আল্লাহর কাছেই বাইয়া’ত হচ্ছিল। তাদের হাতের ওপর আল্লাহর (কুদরতের) হাত ছিল। (সূরা ফাতহা-১০)

    يَاايٌهَا النَّبِىٌّ اِذا جَاءَكَ المُؤمِنتِ ﻳُﺒَﺎﻳِﻌْﻧَﻚَ-
     

    অর্থাৎ, হে রাসূল (দ:)! যে সকল মু’মিন মহিলারা আপনার কাছে বাইয়াত হওয়ার জন্য আসে (মুরিদ হওয়ার জন্য আসে), তাঁদেরকে আপনি বাইয়া’ত দান করুন। (সূরা মুমতাহানা: ১২)

    হাদিছ শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত আওফ বিন মালেক আশ’আরী (রা:) বলেন, আমরা ৯ জন কিংবা ৮ অথবা ৭ জন নবী করীম (দ:)-এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। হযরত নবী করীম (দ:) বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রাসূলের হাতে বাইয়া’ত হবে না? আমরা নিজ নিজ হাত প্রসারিত করে দিলাম এবং বললাম, হে আল্লাহ’র রাছুল (দ:) কোন বিষয়ের বাইয়া’ত হবো? নবী পাক (দ:) বললেন, এ বিষয়ের ওপর যে তোমরা আল্লাহ পাকের এবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করবে এবং যাবতীয় হুকুম-আহকাম শুনবে ও মান্য করবে। (মুসলিম, আবু দাউদ ও নাছাই শরীফ)


    অন্য হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে -


    وَ مَن مَاتَ وَ لَيسَ فىِ عُنُقِهِ بَيعَةُ مَاتَ مِيتَةَ جَاهِلِيَّةُ-
     

    অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যু বরণ করলো যে, তার গর্দানে বাইয়া’তের (আনুগত্যের) বেড়ি থাকলো না, সে জাহেলীয়াতের মৃত্যুতে মৃত্যু বরণ করলো। (মুসলীম শরীফ: কিতাবুল ইমারা, হাদীছ নং-৪৮৯৯)।

    পীর মাশায়েখগণের মধ্যে বাইয়া’ত করার যে প্রথা প্রচলিত তার সারমর্ম হলো জাহেরী ও বাতেনী আমলের ওপর দৃঢ়তা অবলম্বন করা এবং গুরুত্ব প্রদান করার অঙ্গীকার করা। তাঁদের পরিভাষায় একে বাইয়া’তে তরীকত, অর্থাৎ, তরীকতের কাজ বা আমল করার অঙ্গীকার করা। কেউ কেউ এ বাইয়া’তকে অস্বীকার করে থাকেন। কারণ হিসেবে বলেন যে হুজুর পাক (দ:) হতে তা বর্ণিত নেই। তখন শুধু কাফেরদেরকে ইসলামের বাইয়া’ত করার দরকার ছিল। কিন্তু উল্লেখিত হাদীছ শরীফে এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান। তাই অনেক ইমাম মুজতাহিদ আলেমগণ বলেছেন- من ليس له شيخ فشيخه الشيطان ‘মান লায়ছা লাহু শায়খুন ফা-শায়েখুহুশ শয়তানুন’ ( জুনায়েদ বাগদাদী রহ:)। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কোনো হাক্কানী পীর বা শায়েখের বাইয়া’ত গ্রহণ করেনি, তার শায়খ বা ওস্তাদ হয় শয়তান। শয়তান-ই তাকে গোমরাহ বা বিভ্রান্ত করে দেয়। কাজেই গোমরাহী থেকে বাঁচা যেহেতু ফরজ, সেহেতু পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়া ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই পীর-মুর্শিদের কাছে বাইয়া’ত হওয়াও ফরজ। আর ঠিক এ কথাটি বলেছেন আমাদের হানাফী মজহাবের ইমাম, ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ:)। তিনি বলেন, “লাওলা ছানাতানি লাহালাকান নোমান”। অর্থাৎ, “আমি নোমান বিন ছাবিত যদি দু’টি বছর না পেতাম তবে হালাক হয়ে যেতাম”। অর্থাৎ, যদি আমি আমার পীর সাহেব ইমাম জাফর সাদেক (রা:)-এর কাছে বাইয়া’ত হয়ে দু’টি বছর অতিবাহিত না করতাম, তবে আত্মশুদ্ধি লাভ না করার কারণে গোমরাহ ও হালাক (ধ্বংস) হয়ে যেতাম।


    আর বিখ্যাত কবি, দার্শনিক ও আলেমকুল শিরোমণি বিশিষ্ট সুফি সাধক হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রহ:) বলেন -


    “মাওলানা রুম হারগেজ কামেল নাশুদ; তা গোলামে শামছে তিবরীজ নাশুদ”


    অর্থাৎ, আমি মাওলানা রুমী ততোক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ-ওয়ালা হতে পারিনি যতোক্ষণ পর্যন্ত আমার পীর হযরত শামছে তাবরীজ (রহ:)-এর কাছে বাইয়া’ত হয়ে এলমে তাছাউফ আমল করে এখলাছ হাছিল না করেছি। অর্থাৎ, এলমে তাছাউফ আমলের মাধ্যমে এখলাছ অর্জন করার পরই আমি হাকীকি মু’মিন হতে পেরেছিলাম (মসনবী)।


    তাই কাদেরীয়া তরীকার ইমাম হযরত গাউছুল আযম মাহবুবে ছোবহানী কুতুবে রব্বানী গাউছে সামদানী শায়খ মহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জীলানী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত কেতাব “সিররুল আসরার”-এর ৫ম অধ্যায়ে তওবার বয়ানে লিখেছেন, ক্বলব বা অন্তরকে জীবিত বা যাবতীয় কু-রিপু হতে পবিত্র করার জন্য আহলে তালকীন তথা পীরে কামেল গ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। কারণ তাওহীদের রত্ন (বীজ) কোনো যোগ্য মুর্শিদের অন্তর থেকে গ্রহণ করতে হবে।


    হাদীস শরীফে যে এলেম অর্জন করা ফরজ বলা হয়েছে তা দ্বারা এলমে মারেফাত ও কোরবতকেই বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও অন্যান্য সর্বজনমান্য ও সর্বজনস্বীকৃত ইমাম-মুজতাহিদ ও আওলিয়া ই-কিরামগণ (রহ:) পীর-মাশায়েখের কাছে বাইয়া’ত গ্রহণ করা ফরজ বলে ফতওয়া দিয়েছেন।


    উদাহরণস্বরূপ, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহ:) তাঁর “এহইয়াউ উলুমুদ্দীন ও কিমিয়া সায়াদাত” কিতাবে, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি আজমেরী (রহ:)-এর মালফুজাত “আনিসুল আরওয়াহ” কিতাবে, ইমামুশ শরীয়াত ওয়াত তরীকত শায়খ আবুল কাশেম কুশাইরী (রহ:) “রিছালায়ে কুশাইরিয়া” কিতাবে, হযরত মাওলানা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি (রহ:) “মালাবুদ্দা মিনহু ও এরশাদুত্তালেবীন” কিতাবে, শাহ আব্দুল আজিজ মহাদ্দিস দেহলভী (রহ:) “তাফসীরে আজিজ” শীর্ষক কিতাবে, আল্লামা শামী (রহ:) “রদ্দুল মোখতার” কিতাবে, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ:) তাঁর “তাফসীরে কবীর” কিতাবে, কাইয়্যুমে আউয়াল আফজালুল আউলিয়া হযরত ইমাম মোজাদ্দেদে আলফে ছানী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত আল-"মাকতুবাত শরীফে”, হযরত ইমাম আহমদ রেফায়ী (রহ:) তাঁর “বুনইয়ানুল মুআইয়্যাদ” কিতাবে, হযরত ইসমাঈল হাক্কি (রহ:) “তাফসীরে রুহুল বয়ানে” সরাসরি পীর গ্রহণ করা ফরজ বলে ফতুয়া দিয়েছেন।
     
    এ প্রসঙ্গে কারামত আলী জৌনপুরীও তার “যাদুত তাকাওয
    ়াতে” লিখেছে যে এলমে তাছাউফ ছাড়া ইলমে শরীয়তের ওপর যথাযথ আমল করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সুতরাং ছাবেত হলো যে এলমে মারেফত চর্চা করা সকলের জন্যই ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। আর এই এলেমে তাছাউফ পারদর্শী মুর্শিদে কামেল-এর সোহবত ও তা’লীম ব্যতিরেকে অর্জন করা কখনও সম্ভব নয়।

     
    হাটহাজারী খারিজিদের মুরুব্বী মুফতী শফি সাহেব স্বয়ং নিজেই “মা’আরেফুল কুরআনে” সূরা বাক্বারায় উক্ত আয়াত শরীফের তাফসীরে লেখেন, আত্মশুদ্ধি অর্জিত হবে না যতোক্ষণ পর্যন্ত এছলাহ-প্রাপ্ত কোনো বুর্যুর্গ বা পীরে কামেলের অধীনে থেকে তালীম ও তরবিয়াত হাসিল না করবে। আমল করার হিম্মত তাওফিক কোনো কিতাব পড়া ও বোঝার দ্বারা অর্জিত হয় না, তা অর্জন করার একটি-ই পথ; আর তা হলো অলীগণের সোহবত তথা সান্নিধ্য।

     
    পীর-মুর্শিদগণই হচ্ছেন হাকীকি আলেম। কেননা, পীর-মুর্শিদগণই এলমে শরীয়ত ও মারেফত, এই উভয় প্রকার এলমের অধিকারী। আর উক্ত উভয় প্রকারের এলমের অধিকারীগণই হচ্ছেন হাদীছ শরীফের ঘোষণা অনুযায়ী- العلماء ورثة الانبياء প্রকৃত আলেম বা ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া। যেমন এ প্রসঙ্গে ইমামে রব্বানী মাহবুবে সুবহানী কাইয়ূমে আওয়াল সুলতানুল মাশায়েখ হযরত মোজাদ্দেদ আলফে ছানি (রহ:) তাঁর বিখ্যাত কিতাব ’মকতুবাত শরীফে’ উল্লেখ করেন, আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিছ। এ হাদীস শরীফে বর্ণিত আলেম তারাই যাঁরা নবীগণের রেখে যাওয়া এলমে শরীয়ত ও এলমে মারিফত এই উভয় প্রকার এলমের অধিকারী। অর্থাৎ, তিনি-ই প্রকৃত ওয়ারিছ বা স্বত্বাধিকারী। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র এক প্রকারের এলমের অধিকারী, সে নবীগণের প্রকৃত ওয়ারিশ নয়। কেননা, পরিত্যক্ত সম্পত্তির সকল ক্ষেত্রে অংশিদারী হওয়াকেই ওয়ারিছ বলে। আর যে ব্যক্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তির কোনো নির্দিষ্ট অংশের অধিকারী হয়, তাকে ’গরীম’ বলে। অর্থাৎ, সে ওয়ারিছ নয়, গরীমের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে, যারা পীর-মাশায়েখ নয়, অর্থাৎ, শুধু এলমে শরীয়তের অধিকারী ও এলমে তাছাউফ-শূন্য, তারা প্রকৃত আলেম নয়।

     
    অতএব, প্রমাণিত হলো, হক্কানী পীর-মাশায়েখগণই হচ্ছেন প্রকৃত বা খাঁটি আলেমে দ্বীন। ক্বলব জারি করতে হলে তাঁদের কাছে যেতে হবে। যে ব্যক্তি কোনো পীর-মাশায়েখের কাছে বাইয়া’ত হয়ে আত্মশুদ্ধি লাভ করে খিলাফত প্রাপ্ত হয়নি, তার কাছে বাইয়া’ত হওয়া অনুচিত।

     
    অতএব, আত্মশুদ্ধি ও এলমে তাছাউফ অর্জন করা যেহেতু ফরজে আইন, আর কামেল পীর-মাশায়েখ ছাড়া এলমে তাছাউফ বা আত্মশুদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়, সেহেতু একজন কামেল পীর-মুর্শিদ অন্বেষণ করে বাইয়া’ত গ্রহণ করা ফরজ। এটাই গ্রহণযোগ্য, বিশুদ্ধ ও দলীলভিত্তিক ফতওয়া। এর বিপরীত মত পোষণকারীরা বাতিল ও গোমরাহ।

     
    ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ। ওয়াল্লাহু ওয়া রাসূলাহু আ’লামু